মধ্যপ্রদেশের অমরকণ্টক। নর্মদার উৎসভূমি। বিন্ধ্যপর্বতের পাদদেশ। ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন এক তীর্থভূমি। আমাদের কাছে গঙ্গা যেমন পতিতপাবনী; মধ্যপ্রদেশের মানুষের কাছে নর্মদার মাহাত্ম্যও তেমনই। সামবেদপাঠে ভক্ত যে পুণ্য অর্জন করেন, তেমনই পুণ্য অর্জন করা যায় নর্মদায় স্নান করলে। কেননা, নর্মদা নদী শাস্ত্রে সামবেদের সঙ্গে তুলনীয় হয়েছেন। আর বিন্ধ্য পর্বত তো শাস্ত্রমতে দেবতাদের বাসস্থান। তাছাড়া নদী নর্মদার উৎসক্ষেত্রেই রয়েছে এক বিখ্যাত ও জাগ্রত সতীপীঠ। তাই এই তীর্থ, শুধু তীর্থ নয়, এ হল 'মোক্ষতীর্থ'। যুগ যুগ ধরে কত শত শত মহাত্মা, সন্ন্যাসী, সাধু এই তীর্থের নর্মদা তীরে তপস্যার মধ্য দিয়ে মোক্ষলাভ করেছেন। নর্মদা তাই তাঁদের কাছে 'তপোভূমি নর্মদা'। সেই মোক্ষের স্পর্শ পেতেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত সকল ভক্তকুলই চান যে, জীবনে একবার অন্তত এই তীর্থের ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে আসতে।
অমরকণ্টকে প্রায় সমস্ত দেবদেবীদেরই মন্দির রয়েছে। সমস্ত মন্দিরই কমবেশি পাঁচশো, হাজার ও কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন। তৃতীয় গোত্রের মধ্যে পড়ে মা নর্মদার মন্দির। মা নর্মদাই হলেন আমাদের এই সতীপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আসলে কিন্তু দেবীর নাম 'শোণ দেবী'। দেবীর পীঠস্থানটি নর্মদার উৎসস্থলে হওয়ায় লোকমুখে দেবীর নাম হয়েছে, 'নর্মদা দেবী'। 'পীঠনির্ণয় তন্ত্র' গ্রন্থে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে--
'শোণাখ্যা ভদ্রসেনস্তু নর্মদাখ্যে নিতম্বক:'।
শ্লোকাংশটির অর্থ, দেবীর নাম, 'শোণ'; দেবীর ভৈরবের নাম, 'ভদ্রসেন'। আর এই নর্মদায় ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবীর নিতম্ব পতিত হয়েছিল।
দেবীর আসল নাম জানার পর অনেকেই ভাবেন যে, শোণ নদের নাম থেকেই দেবীর এমন নাম হয়েছে। কেননা, নর্মদা নদী ও শোণ নদের উৎপত্তিস্থল প্রায় পাশাপাশি অবস্থিত। কিন্তু মূল ব্যাপার হচ্ছে, দেবীর পীঠভূমি নর্মদার উৎসমুখে অবস্থিত, শোণ নদের উৎসমুখে নয়। তবুও প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থে দেবীর 'শোণ' নাম কেন উল্লিখিত হল, তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আমাদের অনুমান, নর্মদা শাস্ত্রে পবিত্র নদী হিসেবে ও মোক্ষদাত্রীরূপে পরিকীর্তিতা হলেও শোণ নদ সেই মর্যাদা পায়নি। তাই শোণ নদকে ভক্তজনের কাছে নর্মদাতুল্য গ্রহণীয় ও আদরণীয় করে তুলতেই হয়তো প্রাচীনকালে দেবীর নাম দেওয়া হয়েছিল, 'শোণ দেবী'।
পুরাণে নর্মদা নদীর উৎপত্তির কাহিনি রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, নর্মদা হলেন শিবকন্যা। একদা শিব ও পার্বতী প্রেমময় ও আনন্দময় অবসর যাপন করছিলেন। চলছিল ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। সেই খেলা খেলতে খেলতে মহাদেব এক সময় ক্লান্ত হলেন। মানবিক এই ক্রীড়ায় দেবতাদেরও ক্লান্তি আসে। ঘাম নিঃসরণ হয়। মহাদেবের সেই ঘাম সমস্ত অঙ্গ বেয়ে ধারাবহ হয়ে থামল এসে পায়ের পাতায়। থামতেই তা থেকে জন্ম হল এক দেবকন্যার। কন্যা পিতার সমস্ত সদগুণ জন্মগতভাবেই অর্জন করেছিলেন, তাই পিতার পায়ের পাতার ওপরই জন্মের পর ধ্যানস্থ হয়ে পড়লেন। পিতা সদ্যসৃষ্ট কন্যাকে আবিষ্কার করে, তাঁর এই ধ্যানমূর্তি দেখে অত্যন্ত তুষ্ট হলেন। তিনি কন্যার নাম দিলেন 'রেবা'। কন্যার ধ্যানভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করলেন, 'হে পুত্রী, বল পিতার কাছে কী চাও?' রেবা বললেন, 'শাশ্বত তপস্বিনী হতে, পিতা!'
কন্যার এই নিষ্কাম প্রার্থনা শুনে শিব অতিশয় তুষ্ট হলেন। মুগ্ধ হলেন। বললেন, 'তাই হোক পুত্রী। তুমি ধারা থেকে জন্ম নিয়েছ, পার্থিব শরীরে ধারাবতী হয়েই প্রবাহিত হবে। তোমার পুণ্যসলিলে অবগাহন করে তোমার পবিত্র তটভূমিতে তপস্যা করে মোক্ষলাভ সিদ্ধিলাভ সহজে সম্ভব হবে।'
সেই থেকেই রেবা নদী হয়ে প্রবাহিত হলেন। তাঁর তীর সাধকের কাছে 'তপোভূমি' বা সাধনভূমি হয়ে উঠল। প্রাচীন পুরাণ ও শাস্ত্র-মন্ত্র-গ্রন্থে রেবা নদীর মাহাত্ম্য কীর্তিত হল। তারপর সাধু-ঋষির রেবা ধীরে ধীরে আপামরের 'নর্মদা' হয়ে উঠল, পরবর্তী পৌরাণিক যুগে। তারপর একদা এই নর্মদারই উৎসভূমি সাধারণের কাছে সতীপীঠরূপে পরিগণিত হল। স্থাপিত হল মন্দির; প্রতিষ্ঠিত হল দেবীর প্রতীকী মূর্তি। এ-সব বহু প্রাচীনকালের কথা।
দেবীর মন্দির শ্বেত-শুভ্র রঙে পবিত্র। মন্দিরের মাথায় গম্বুজ ও চূড়া। মন্দির ঘিরে রয়েছে পবিত্র পুস্করিণী। নাম, 'মার্কণ্ডেয় কুণ্ড'। তাতে কাজলের মতো স্বচ্ছ জল। এতে স্নান করা যায় না। এই জল হাত দিয়ে তুলে মাথায় ঠেকিয়ে তারপর দেবীমায়ের মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহের মধ্যিখানে রয়েছে দেবীর বেদি। সুদৃশ্য রুপোর পাত দিয়ে বেদি মোড়ানো রয়েছে। আর এই বেদির মধ্যিখানেই রয়েছে কষ্টিপাথরে নির্মিত দেবীর মূর্তি। মূর্তির উচ্চতা তিন ফুট। দেবী দ্বিভুজা। তাঁর এক হাতে কমণ্ডলু, অন্য হাতে বরাভয়। রেবা বা নর্মদা পিতা শিবের কাছে যে তপস্বিনী হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন, দেবীর কষ্টির কায়ারূপে সেই প্রার্থনাই মূর্তিমান হয়ে রয়েছে। এটাও হয়তো দেবীর 'নর্মদা' নাম হয়ে ওঠার একটা কারণ। সবচেয়ে লক্ষ করার যেটা, তা হল, দেবীর মূর্তিতে কোথাও সতীকালিকার রুদ্ররূপের ছায়া পর্যন্ত নেই--এমনটা অন্য কোন মূর্তিযুক্ত সতীপীঠে চোখে পড়ে না। দেবী এখানে শান্ত, সৌম্যা, সাধ্বী; মোক্ষদায়িনী ও বরাভয়দাত্রী। তাই ভক্তজনের বিশ্বাস, দেবীর মন্দিরে প্রবেশ করলেই প্রতিটি ভক্তের চিত্তশুদ্ধি হয়, মোক্ষের পথ প্রশস্ত হয়, সমস্ত কলুষ নাশ হয়।
দেবী একক অবস্থানে বিশ্বাস করেন না। তিনি সকলের সঙ্গে সহাবস্থানের আদর্শ তুলে ধরে ভক্তজনকে শিক্ষা দিতে চান। তাই তাঁর গর্ভগৃহের বেদিতে তাঁরই আশেপাশে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মন্দির আশেপাশেও বিভিন্ন দেবদেবীর উন্মুক্ত থান ও ছোট ছোট মন্দির। এছাড়া মন্দিরের চৌহদ্দি জুড়ে মার্কণ্ডেয় কুণ্ডের পাড় ঘিরে রয়েছে বেশকিছু দেবদেবীর মন্দির। দেবী কোন সন্তানকেই ছোট ভাবেন না, তুচ্ছ ভাবেন না; সকলকে সমানভাবে কৃপা করেন। সমস্ত মত ও পথের ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে থাকার নিদর্শন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। আসলে, তপস্বিনী ও সাধ্বী দেবী বলতে চান, এটাই একমাত্র মোক্ষের পথ। দেবীর কৃপায় যে ভক্তের এই জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হয়, একমাত্র তিনিই এই শিক্ষা নিতে পারেন।
অমরকণ্টক দেবীর পীঠভূমি ছাড়াও বহু বিশিষ্ট প্রাচীন মন্দির ও প্ৰাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে অসংখ্য পর্যটকের আগমন ঘটে। তাঁরা দেবীর মন্দিরে দর্শনের জন্য অবশ্যই একবার আসেন। ফলে, নিত্যদিন স্থানীয় মানুষ ছাড়াও প্রচুর ভক্তের আগমন ঘটে এই মন্দিরে। 'নবরাত্রি', 'দীপাবলি', 'শিবরাত্রি' ও 'রামনবমী' প্রভৃতি পার্বণ এই মন্দিরে খুব জাঁকজমক ও ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। ফলে, এই সব বিশেষ পার্বণে উপস্থিত থেকে নয়ন তৃপ্ত করে দেখে কৃতার্থ হতেও প্রচুর ভক্তজন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই মন্দিরে ছুটে আসেন।...