"তোমার প্রস্থানে তাই বাজাব না প্রয়াণদুন্দুভি,
লিখব না চোখের জলে পরিপ্লুত একটিও এলিজি,
শুধু ভালোবাসা নিয়ে এইমাত্র যা-কিছু লিখেছি…"
নীললোহিতের প্রয়াণে লিখেছিলেন, এ জীবন মৃত্যুর চেয়ে শক্তিশালী। তাই সতীর্থর চলে যাওয়ায় প্রয়াণদুন্দুভি বাজবে না। চোখের জলে নয়, বন্ধুস্মৃতি জেগে থাকবে ভালোবাসায়।
কবি নীরেন্দ্রনাথের স্মরণলিপিতে লিখেছিলেন,
"কী দেখলে তুমি রৌদ্রকঠিন হাওয়ার অট্টহাসি
দুহাতে ছড়িয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর মৃত্যুর প্রেতসেনা
মাঠে মাঠে বুঝি ফিরছে? ফিরুক, তবু তার পাশাপাশি
কৃষ্ণচূড়ার লাবণ্য তুমি একবারও দেখলে না?"
সতীর্থদের তিনি বিদায় জানিয়েছিলেন এভাবেই। তাঁদের টানেই বারবার ফিরে আসতেন শহরে। প্রতি শীত-হেমন্তে। সেই শীতেই বিদায় নিলেন কবি। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।
তাঁকে বাংলা কবিতার যুবরাজ বলেছিলেন বন্ধু শঙ্খ ঘোষ। সময়টা পঞ্চাশের দশক। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘যৌবন বাউল’।
ভাষার লালিত্য, ছন্দের ব্যবহার আর উপমার টান এই তিন দিয়েই আলোড়ন তুলেছিলেন পাঠক মহলে। কবিতার দর্শন সব সময় পাঠককের চেতনাকে জাগায়। প্রকৃতি-ঈশ্বর-বিশ্ব একাকার।
১৯৩৩ সালের ৬ অক্টোবর কলকাতায় জন্ম হয় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পড়াশোনা বিশ্বভারতীতে। তারপরে সেন্ট জেভিয়ার্স আর প্রেসিডেন্সি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ভারতীয় কবিতায় গীতি নিয়ে পিএইচডি করেন। তখন থেকেই চলতে থাকে তাঁর জার্মান ভাষা চর্চা। লিটিল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জার্মান সাহিত্যের তাঁর করা বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হত সে সময়।
পিএইচডি শেষ হলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে ও বাংলা পড়িয়েছেন দীর্ঘদিন। পরে তিনি হাম্বোলড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপে জার্মানি যান। ১৯৭১ সাল থেকে তিনি জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনসিটিটিউটে অধ্যাপনা করেছেন। ডয়চে-ইন্দিসচে গেসেলশ্যাফ্টের (ডিআইজি) সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
কিন্তু অলোকরঞ্জনের কবিতা এক সময় সাহিত্যপ্রেমি বাঙালির আত্মপরিচয় হয়ে উঠেছিল। তাঁর কলম আশ্চর্য এক বিস্ময় সমকালের কাছে। একদিকে নিজের মাটির প্রতি বাউল টান অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বীক্ষা এই দুই দিককে মিলিয়েছিলেন আশ্চর্য প্রজ্ঞায়।
কবিতা, জীবন, সমাজ, পৃথিবী সব কিছু নিয়েই তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট। কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘কবি যখন লিখবেন, তখন তাঁর মুখটা নামানো থাকবে বুকের কাছে, ওখানে যেন একটা পেসমেকার আছে। জীবন ও মৃত্যুর খুব মাঝখান থেকে তিনি লিখবেন, ঝুঁকে পড়ে। এবং তিনি লিখবেন মানুষেরই জন্য।
কবিতা সম্পর্কে সেই তাঁর দর্শন। এই বলিষ্ঠতার জোর তাঁর আজীবনের সঙ্গী। তাই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চায়ের আমন্ত্রণে রাজভবনের ভরা সভাতেও বিরুদ্ধে মত জানাতেও তিনি দ্বিধাহীন।