বিহারের টিকুলি শিল্প মন জয় করেছিল মোগল বাদশাদেরও

কপালে দুই ভ্রু-র ঠিক মাঝখানটিতে ছোট্ট একটা বিন্দু। সারা দেশ তাকে চেনে বিন্দি নামে। এক ফোঁটা এই বিন্দুই বাকি পৃথিবীর কাছে এক পরম কৌতুহলের বস্তু। বিন্দি ভারতীয় নারীদের আলাদা করে চেনা যায় 'বিন্দি'দিয়ে। সংস্কৃতির অঙ্গ।

 কিন্তু কীভাবে জন্ম হল বিন্দির?

আন্দাজ করা হয় ‘টিকুলি’ নামক গহনা থেকে বিন্দির প্রচলন।

টিকুলি এক প্রাচীন শিল্প রীতি।বিহারের পাটনায় ৮০০ বছর আগে এই শিল্পের উদ্ভব হয়।

টিকুলি শিল্পকে স্থানীয় ভাষায় ‘টিকলি’ বা ‘বিন্দি’ও বলা হয়ে থাকে।

প্রথমে স্থানীয় মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে ছবি আঁকা হত। এই শিল্পরীতি কেবলমাত্র বিহারেই দেখা যায়। দেশের অন্য প্রান্তে টিকুলি শিল্পরীতির প্রয়োগ নেই বললেই চলে। কবে কারা টিকুলি শিল্পরীতির প্রথম সূচনা করেন তা নিয়ে কোনও ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

মৌর্য যুগে এই শিল্পের বিকাশ ঘটে।এই যুগের মহিলাদের ছবি এবং প্রাপ্ত ভাস্কর্য, এবং মন্দির গাত্রের মূর্তিতে টিকুলির ব্যবহার দেখা গিয়েছে।

বিশেষ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে রাজবধূরা কপালে টিকুলি বা বিন্দি পরতেন।

ফা হিয়েন তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে উল্লেখ করেন পাটলিপুত্র নগরের রাজপুরনারী কপালে দেখা টিকুলি বা বিন্দির কথা।

গুপ্ত যুগেও নারীদের মধ্যে টিকুলির ব্যবহার দেখা যেত।

তবে মোঘল আমলে টিকুলি শিল্পরীতির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে।শিল্পীদের কদর বাড়ে।

বেনারস, পাটনা এবং কলকাতায় টিকুলির চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি।

পরবর্তী সময়ে পর্তুগীজ এবং তিব্বতী বণিকরা বাণিজ্যের কারনে পাটলিপুত্রে এলে তাদের খরিদ তালিকাতেও থাকত বিন্দি আর বালা।

FotoJet - 2019-11-06T202526.646

 কাচ আগুনে গলালে বেলুনের মতো ফুলে যেত। সেটি থান্ডা হলে কেটে নিয়ে পছন্দমতো আকার দেওয়া হত। তার ওপর সোনার পাত বসিয়ে বাঁশের তৈরি সূচালো পেনসিল আর রং দিয়ে ছবি ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। সেই ছবির ওপর সোনা এবং অন্যান্য দামী রত্ন খোদাই করা হত। পুরো কাজটি করতে সাত থেকে দশ দিন সময় লাগত।

 বসন্ত আর গ্রীষ্মে টিকুলি শিল্পরা বেশি ব্যস্ত থাকেন আজও।    

টিকুলিতে মৈথিল শিল্পরীতির প্রভাব স্পষ্ট। মূলত শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা কাহিনী বিহারের বিভিন্ন লৌকিক উৎসব, বিবাহের দৃশ্য রূপ দেওয়া হয়।

তবে সেই সময়ে যে সমস্ত পুঁথি বা গ্রন্থ রচিত হয়েছিল তাতে কিন্তু জনপ্রিয় এই শিল্পরীতি বা টিকুলি ব্যবহারের সামাজিক প্রথা নিয়ে বিশদ কোনও তথ্য মেলে না। কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রও একইভাবে নীরব।

অষ্টাদশ শতকে ভারতীয় চিত্রশিল্পের জগতে গুরুত্ব পেতে শুরু করে টিকুলি শিল্প। পাটলা ছাড়িয়ে বিহারের অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। উনিশ শতকে ইউরোপেও পৌঁছে যায়।

অনেকেই মৈথিল চিত্রকলা এবং টিকুলি শিল্পকে এক করে ফেলেন। কিন্তু এই দুই শিল্প ঘরানার মূল পার্থক্য হল মৈথিল শিল্পে কাপড় বা কাগজের ব্যবহার হয়। কিন্তু টিকুলি কাচের ওপর।

এখন অবশ্য ফাইবার বা হার্ডবোর্ডের মতো মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে এই শিল্পে। তার ওপর এনামেলের কোটিং দিয়ে কাঠের ওপর আটকে তৈরি হচ্ছে ক্যানভাস। কাচ, সোনার ব্যবহার অনেকটাই কমে গিয়েছে অত্যাধিক দামের কারনে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্যও অনেক শিল্প সচেতন ভাবে এই শিল্পের মাধ্যম বদল করছেন। অর্থনৈতিক দিকটিও বড় কারণ।

FotoJet - 2019-11-06T202501.627

টিকুলি শিল্প এখন অনেকটাই হারিয়ে যাওয়ার পথে। বেশিরভাগ শিল্পী পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে পেটের তাগিদে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।

 মহিলা শিল্পীদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে টিকুলি শিল্পে। এই প্রাচীন শিল্পরীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং তাঁদের স্বনির্ভর করে তুলতে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৩০০ মহিলা এই শিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে নিজেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।  

এখন বিদেশের প্রদর্শনীতে নিয়মিত পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন শিল্পীর কাজ। যা আশা জাগাচ্ছে অন্য শিল্পীদের

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...