বিষ্ণুদেবের পঞ্চম অবতার বামন। দেবগুরু বৃহস্পতির প্রতীক রূপ হিসাবে মানা হয়।
পুরাণে বর্ণিত বামন অবতারের কাহিনি অনুযায়ী, মহামতী রাজা বলী শ্রীহরি ভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র্র এবং বিরোচনের পুত্র ছিলেন।
তিনি দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের আশীর্বাদে প্রচন্ড শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। দৈত্যরাজ হলেও বলী ছিলেন ধর্মপ্রাণ। দাতা হিসেবে ত্রিভুবনে বিখ্যাত। মহা পরাক্রমশালী রাজা বলী মর্ত্যলোক এবং পাতাল জয় করার পর, স্বর্গের রাজধানী অমরাবতী অধিকারের জন্য দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের পরামর্শে বিশ্বজিৎ যজ্ঞ শুরু করেন।
সেই যজ্ঞের যজ্ঞকুন্ড থেকে একে একে আবির্ভূত হয় দেবরাজ ইন্দ্রের রথের সাদৃশ্য বহু মূল্যবান রত্নখোচিত সুসজ্জিত রথ, অক্ষয় বাণ, সোনার ধনুক এবং দিব্যবর্ম। তথায় উপস্থিত প্রজাপতি ব্রহ্মা দান করিলেন দিব্যমাল্য আর শুক্রাচার্য্য দিব্য শঙ্খ।
যজ্ঞকুন্ড হইতে আবির্ভূত সমস্ত দিব্যবস্তু ধারণ করিয়া সম্রাট বলী নতজানু হয়ে পিতামহ প্রহ্লাদ, গুরু শুক্রাচার্য্য এবং যজ্ঞ ভূমিতে উপস্থিত সমস্ত ঋষিদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করিলেন। তাঁদের আশীর্বাদে ধন্য হয়ে স্বর্গের রাজধানী অমরাবতী জয়ের লক্ষ্যে এগোতে থাকেন। ইন্দ্রের রাজধানী অধিকার করতে খুব বেশি বেগ-বাধা পেতে হয়নি তাঁকে। দেবতাদের স্বর্গ হইতে বিতাড়িত করে বলী স্বর্গ, মর্ত্য পাতালের একছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন। ত্রিলোকের অধীশ্বর তখন তিনি।
একদিকে ইন্দ্রসহ অন্যান্য দেবতাদের দেখে দেবমাতা অদিতি ও পিতা কাশ্যপ ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। মাতা অদিতির কঠোর ব্রতে সন্তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাঁর গর্ভে জন্ম নিলেন বামনদেব রূপে।
ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্ত হতে লাগলেন বামনদেব। অন্যদিকে দৈত্যশ্রেষ্ঠ বলীরাজ আবার দৈত্যাচার্যের পরামর্শে অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রস্তুতি শুরু করলেন। যজ্ঞ উপলক্ষ্যে মহাদান পর্ব শুরু হল। কেউ খালি হাতে বলী রাজার গৃহ থেকে ফিরবে না।
দেবগুরু বৃহস্পতিকে নিয়ে বামনদেব উপস্থিত হলেন রাজা বলীর অশ্বমেধ যজ্ঞসভায়।
সাধারণ ব্রহ্মচারীর মতো পরিধান, কিন্তু উজ্জ্বল চেহারা চোখ টেনে নিল সকলের। রাজা বলীর হৃদয়ও স্নেহার্দ্র হল বালক বামন সন্ন্যাসীকে দেখে।
রাজা বালী স্বয়ং তাঁর পা ধৌত করলেন। সেই পর্ব মিটলে বালককে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর কী প্রার্থনা। ধন, ঐশ্বর্্য থেকে শুরু করে যা তিনি ইচ্ছা করবেন সব দিতে তিনি প্রস্তুত।
প্রত্যুত্তরে বামন অবতার রাজা বলী ও তাঁর বংশের পূর্বসূরিদের প্রশংসা করে জানালেন, ‘ধন, সাম্রাজ্য, ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা প্রাপ্তির কোনও অভিলাষ তাঁর নাই। তাঁর প্রয়োজন কেবলমাত্র তিন পদক্ষেপের সমপরিমাণ জমি, দেবগুরু বৃহস্পতির জন্য যজ্ঞশালা নির্মাণ হেতু।
বামন দেবের কথা শুনে অট্টহাস্য করলেন দৈত্যরাজ। তিনি বললেন, যিনি ত্রিলোকের অধীশ্বর তাঁর কাছে মাত্র ত্রিপদ ভূমি আকাঙ্খা করছেন বালক!
বামনদেব জানালেন, জীবনের ইচ্ছে সব সময় সংযত হওয়া উচিত। তাই তাঁর আকাঙ্খা কেবল তিনপদ ভূমি।
এবার আর দ্বিরুক্তি করলেন না বলীরাজ, তিনি সম্মত হলেন তাঁর ইচ্ছেয়। কিন্তু বামন দেবের প্রকৃত পরিচয় সম্বন্ধে অবগত ছিলেন শুক্রাচার্য্য। তাই তিনি বারবার সাবধান করতে লাগলেন বলীকে। কিন্তু সাবধান বলীরাজ নিজের সত্য থেকে সরলেন না।
রাজা বলী জমি প্রদানের জন্য অগ্রসর হলেন। বামনদেব তাঁর প্রথম পদক্ষেপে মর্ত্যলোক অধিকার করলেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপ সমগ্র স্বর্গলোক। তৃতীয় পদক্ষেপ রাখবার আর কোন স্থান নেই দেখে বলীকে জিজ্ঞাসা করলেন তৃতীয় পদ তিনি রাখবেন কোথায়?
রাজা মহাবলী তখন সশ্রদ্ধায় নিজের মস্তক অগ্রসর করে দিলেন বামন অবতার রূপী ভগবান নারায়ণকে, তাঁর তৃতীয় পদক্ষেপ রাখবার জন্য। ভগবান নারায়ণ বলীকে পাতাললোকে প্রেরণ করলেন। স্বর্গরাজ্য আবার দেবতাদের হল।
শ্রীবিষ্ণু মহারাজ বলীকে আশীর্বাদ করলেন, ‘তিনি চিরঞ্জিবী হবেন। দৈত্যকুলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট এবং শ্রীহরির প্রিয়ভক্ত হিসাবে পূজিত হবেন মর্ত্যলোকে।
সেই থেকে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে রাজা বলীর পুজো হয়ে থাকে।