পরশুরাম শ্রী বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। তিনি ত্রেতা এবং দ্বাপর যুগে বর্তমান ছিলেন। পরশুরামের পিতা জমদগ্নি হলেও, মা রেণুকা ছিলেন ক্ষত্রিয়।
পরশুরামের জন্ম নিয়ে নানা কাহিনি পাওয়া যায়। সেসব কাহিনি বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় বটে। ভাগবত পুরাণ অনুসারে, একসময় পৃথিবীর বুকে ক্ষত্রিয়দের প্রভাব-প্রতিপত্তি খুবই বেড়ে যায়। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সকলে ব্রক্ষা ও বিষ্ণুর কাছে অভিযোগ জানায়। ক্ষত্রিয় প্রতিপত্তি আটকাবার জন্য ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর বরে পরশুরাম জন্মগ্রহণ করেন।
অন্য আর একটি কাহিনি বলে, গাভীরূপ ধারণ করে বিষ্ণুর কাছে ক্ষত্রিয় অত্যাচারের কথা জানান। তারপরই পরশুরাম রূপে বিষ্ণুর আবির্ভাব হয়।
মহর্ষি জমদগ্নির ঔরসে রেণুকার গর্ভে পরশুরামের জন্ম হয়। তাঁদের পাঁচ পুত্রের মধ্যে পরশুরাম কনিষ্ঠতম। বাল্য থেকেই পরশুরামের অস্ত্রশস্ত্রে আগ্রহ। পরশুরাম জানতেন যে কী কারণে তাঁর পৃথিবীতে আসা। ক্ষত্রিয় দমনের জন্য নিজেকে সব রকমভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করেন নিজেকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে তাঁর তেজ, রাগ আর অহং।
শুরু করেন কঠোর তপস্যা। তিনি ছিলেন শিবের উপাসক। শিবকে সন্তুষ্ট করে বর হিসেবে কুঠার লাভ করেন। অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতীক হয়ে ওঠে শিবের কুঠার। তাঁর লক্ষ্য ছিল পৃথিবী ক্ষত্রিয়শূন্য করা। প্রবল পরাক্রমশালী পরশুরাম ব্রাহ্মণ জন্ম গ্রহণ করলেও কর্মে ছিলেন ক্ষত্রিয়। তিনি পৃথিবীর যোদ্ধা ব্রাহ্মণ। ২১ বার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন তিনি।
পরশুরামকে ঘিরে আছে একাধিক কাহিনি। তিনি পিতা জমদগ্নির আদেশে মা রেণুকার শিরোচ্ছেদ করেছিলেন। পিতার দেওয়া মাতৃ হত্যার আদেশ তাঁর বাকি ভ্রাতারা পালন করতে রাজি হননি, তাই তাঁরা জড়ে পরিনত হন। পরশুরামের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে পিতা বর দিতে চাইলে তিনি মায়ের পুনর্জন্ম, ভাইদের জড়ত্বমুক্তি, নিজের অজেয়ত্বের বর প্রার্থনা করেন। পিতা সম্মত হন। কিন্তু পরশুরামের হাতের কুঠারটি তাঁর হাতে লেগেই রইল। কিছুতেই বিচ্ছিন্ন করা গেল না তাকে।
পিতার কাছে এই ঘটনার কারণ জানতে চাইলে তিনি পুত্রকে বলেন, মাতৃহত্যার পাপ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এ কুঠারটি তার হাত থেকে বিযুক্ত হবে না।ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করার পর মাতৃহত্যার পাপ থেকে তিনি মুক্ত হন। তবেই হাত থেকে আলাদা হয় সেই কুঠার।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে, একবার পরশুরাম শিবকে দেখতে কৈলাস পর্বতে যান। তখন ভগবান গণেশ শিবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় তাঁর পথরোধ করেন। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি কুঠার দিয়ে ভগবান গণেশের একটি দাঁত ভেঙে দেন। তারপর থেকেই ভগবান গণেশ একদন্ত নামে পরিচিত হন।
ক্ষত্রিয়দের প্রতি পরশুরামের অন্ধ ক্রোধের পশ্চাতে আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। একবার কার্তবীর্য নামে এক রাজা কামধেনু গাভীকে হরণ করেছিলেন। পরশুরাম সেই গাভী উদ্ধার করেন। সেই রাগে রাজার পুত্ররা রাতের অন্ধকারে এসে পরশুরামের পিতা জমদগ্নির আশ্রমে আগুন লাগায়। দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় জমদগ্নির। পিতাকে ওই অবস্থায় দেখে পরশুরাম সেই রাজার সমস্ত পুত্রকে হত্যা করেন।
পরবর্তী সময়ে ধরনী ক্ষত্রিয়শূন্য করে পরশুরাম তাদের রক্তে পাঁচটি হ্রদ তৈরি করেন। পরে অনুশোচনায় পিতৃপুরুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং অনুরোধ করেন, যাতে পাঁচটি হ্রদ পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। পিতৃপুরুষরা তাঁকে পাপমুক্ত করেন। পাঁচটি রক্ত হ্রদ একসঙ্গে সমন্তপঞ্চক বা কুরুক্ষেত্র বলে পরিচিতি লাভ করে।
কথিত আছে, তিনি সমুদ্রের আগ্রাসন থেকে কোঙ্কন ও মালাবার অঞ্চলকে রক্ষা করেছিলেন। এই কারণে কেরল ও কোঙ্কণ উপকূলীয় অঞ্চলকে পরশুরাম ক্ষেত্র বলা হয়। মহারাষ্ট্রের রত্নগিরিতে আছে শ্রীক্ষেত্র পরশুরাম। দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত পরশুরাম মন্দির এটি। এচাড়া কেরালা এবং কর্ণাটকেও পরশুরাম মন্দির আছে।