নৃসিংহ তথা নরসিংহ বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার। মৎস, কূর্ম, বরাহের পর সত্যযুগে নৃসিংহ অবতারে আবির্ভাব ঘটে বিষ্ণুর। ভগবান বিষ্ণুর এই অবতারকে শৌর্যের প্রতীক হিসেবে মানা হয়।তিনি মহা রক্ষক। অতীতে যোদ্ধারা নৃসিংহ অবতারের পুজো করতেন।আবার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ও তাঁর উপাসক।
অর্ধেক মানুষ এবং অর্ধেক সিংহ রূপ তাঁর। দেহ মনুষ্যাকার। মস্তক ও নখর সিংহের মতো। মৎসপুরাণ মতে নৃসিংহদেব অষ্টভূজ বিশিষ্ট। অগ্নিপুরাণ বলে তিনি চতুর্ভূজ।
পূর্ববর্তী বরাহ অবতারে শ্রী বিষ্ণু হিরণ্যাক্ষ নামে এক অসুরকে বধ করেন। তাঁর পরবর্তী অবতারের লীলার বীজ এই কাহিনিতেই রাখা।
বিষ্ণুর হাতে নিহত হিরণ্যাক্ষের ভাই হিরণ্যকশিপু এই কারণেই হয়ে ওঠেন প্রবল বিষ্ণুবিদ্বেষী। দাদার হত্যার প্রতিশোধ নিতে তিনি ছিলেন বদ্ধ পৃকর। নানাভাবে প্রতিশোধের পথ খুঁজতে থাকেন।
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করার অভিলাষে শুরু করেন কঠোর তপস্যা। বছরের পর বছর ধরে একাস্নে তপস্যা করে চললেন তিনি। এক সময় ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে অবতীর্ণ হলেন হিরণ্যকশিপুর সামনে। বরদান করতে চাইলেন তিনি। প্রজাপতি ব্রহ্মাকে হিরণ্যকশিপু বললেন,
“আমায় এমন বরদান করুন যার প্রভাবে আপনার সৃষ্ট কোনো জীবের হস্তে আমার মৃত্যু ঘটবে না। যে বরে আমার বাসস্থানের অন্দরে বা বাহিরে আমার মৃত্যু ঘটবে না। দিবসে বা রাত্রিতে, ভূমিতে বা আকাশে আমার মৃত্যু হবে না। অস্ত্র, মনুষ্য বা পশুর হাতে আমার মৃত্যু হবে না।
যে বরে কোনও জীবিত বা মৃত সত্তার হাতে আমার মৃত্যু হবে না; কোনও উপদেবতা, দৈত্য বা পাতালের মহানাগ আমাকে হত্যা করতে পারবে না।
এখানেই শেষ হল না তাঁর শর্ত। তিনি ব্রহ্মাকে আরও বললেন,
“ আমাকে এমন বর দিন যাতে যুদ্ধক্ষেত্রে আমারও কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকে। এমন বর দিন যাতে সকল জীবসত্তা ও প্রভুত্বকারী দেবতার উপর আমার একাধিপত্য স্থাপিত হয় এবং আমাকে সেই পদমর্যাদার উপযুক্ত সকল গৌরব প্রদান করুন। এছাড়া আমাকে তপস্যা ও যোগসাধনার প্রাপ্তব্য সকল ফল প্রদান করুন, যা আমাকে কোনওদিন হারাতে হবে না।”
এদিকে হিরণ্যকশিপু যখন মন্দার পর্বতে তপস্যা করছিলেন, তখন ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণ তার প্রাসাদ আক্রমণ করেন।সেই সময় তাঁর স্ত্রী কায়াদু ছিলেন গর্ভবতী। দেবর্ষি নারদ হিরণ্যকশিপুর নিরাপরাধ স্ত্রীকে রক্ষা করেন। দেবর্ষি দেবগণের কাছে কায়াদুকে ‘পাপহীনা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
নারদ কায়াদুকে নিজের আশ্রমে নিয়ে যান। সেখানে কায়াদু এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। দেবর্ষি নারদ তাঁর নাম দেন ‘প্রহ্লাদ’।
দেব ঋষি প্রহ্লাদকে শাস্ত্রপাঠ দেন। নারদের প্রভাবে প্রহ্লাদ হয়ে ওঠেন পরম বিষ্ণুভক্ত। তবে পুত্রের এহেন আচরণে প্রবল ক্রুদ্ধ হন হিরণ্যকশিপু।
দিনে দিনে বাড়তে থাকে প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্তি। আর এতেই হিরণ্যকশিপুর ক্রোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। নিজের ছিলের প্রতি প্রচন্ড রাগে তাঁকে হত্যায় উদ্যত হন।
ছলে-বলে-কৌশলে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান তাঁকে বধ করার। কিন্তু যতবারই তিনি বালক প্রহ্লাদকে বধ করতে যান, ততবারই বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদের প্রাণ রক্ষা করেন। হিরণ্যকশিপু একদিন পুত্র প্রহ্লাদকে বলেন তাঁকে ত্রিভুবনের অধিপতি হিসেবে মেনে নিতে। প্রহ্লাদ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন বিষ্ণুই এই ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর। তিনিই আদি তিনিই অন্ত। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। সবখানে আছেন তিনি।
হিরণ্যকশিপু তখন প্রাসাদের একটি স্তম্ভ দেখিয়ে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তার বিষ্ণু’ সেখানেও আছেন কিনা?’
প্রহ্লাদ সেই স্তম্ভ দেখিয়ে উত্তর দেন, সেই স্থানে তিনি ছিলেন, আছে ও থাকবেন। তিনি এই স্তম্ভে আছেন, এমনকি ক্ষুদ্রতম যষ্টিটিতেও আছেন।
হিরণ্যকশিপু ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে গদার আঘাতে স্তম্ভটি ভেঙে ফেলেন। তখনই সেই ভগ্ন স্তম্ভ থেকে নৃসিংহের মূর্তিতে আবির্ভূত হন বিষ্ণু।
ব্রহ্মার বর যাতে বিফল না হয়, অথচ হিরণ্যকশিপুকেও হত্যা করা যায়, সেই কারণেই বিষ্ণু নরসিংহের বেশ ধারণ করেন। হিরণ্যকশিপু দেবতা, মানব বা পশুর মধ্য নন, তাই নৃসিংহ পরিপূর্ণ দেবতা, মানব বা পশু নন; হিরণ্যকশিপুকে দিবসে বা রাত্রিতে বধ করা যাবে না, তাই নৃসিংহ দিন ও রাত্রির সন্ধিস্থল গোধূলি সময়ে তাকে বধ করেন; হিরণ্যকশিপু ভূমিতে বা আকাশে কোনও শস্ত্রাঘাতে বধ্য নন, তাই নৃসিংহ তাকে নিজ জঙ্ঘার উপর স্থাপন করে নখরাঘাতে হত্যা করেন; হিরণ্যকশিপু নিজ গৃহ বা গৃহের বাইরে বধ্য ছিলেন না, তাই নৃসিংহ তাকে বধ করেন তারই গৃহদ্বারে।
এই কাহিনি এখানেই শেষ নয়, তার আরও একটি পর্ব আছে।
ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, হিরণ্যকশিপুকে বধ করার পর সকল দেবতাই নৃসিংহদেবের ক্রোধ নিবারণে ব্যর্থ হন। এমনকি স্বয়ং শিবও নৃসিংহরূপী বিষ্ণুকে শান্ত করতে বিফল হন। সকল দেবগণ তখন তাঁর পত্নী লক্ষ্মীকে ডাকেন। কিন্তু লক্ষ্মীও স্বামীর ক্রোধ নিবারণে অক্ষম হন। তখন ব্রহ্মার অনুরোধে প্রহ্লাদ এগিয়ে আসেন।
ভক্ত প্রহ্লাদের স্তবগানে অবশেষে নৃসিংহদেব শান্ত হন। প্রত্যাবর্তনের পূর্বে নৃসিংহদেব প্রহ্লাদকে রাজা করে দেন।
ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী, নৃসিংহদেব তার সত্য ভক্তদের চরমতম বিপদের সময় রক্ষা করেন। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এক কাপালিক দেবী কালীর নিকট আদি শংকরকে বলি দিতে গেলে নৃসিংহদেব তাকে রক্ষা করেছিলেন। এরপরই আদি শংকর তার প্রসিদ্ধ লক্ষ্মী-নরসিংহ স্তোত্রটি রচনা করেন।
ভারতে ১২ টি বিখ্যাত নৃসিংহ দেবের মন্দির আছে। তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কেরালা, রাজস্থানে অবস্থিত। দেশের দক্ষিণপ্রান্তে নৃসিংহ দেব অতি জনিপ্রিয় দেবতা।