বুড়ো রান্না ‘বুড়ো’ কেন

শিল্প নগরী হাওড়া। এখন সময়ের বিবর্তনে কারখানা পাড়ার সাইরেনের তেজ ফিকে হয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি। বিশ্বকর্মা পুজোর তারিখ কাছাকাছি এলেই গমগমে হয়ে ওঠে হাওড়ার অলিগলি। কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় মেশিনের তেল-কালি ঝুলি পরিষ্কার করতে করতে স্তুপ জমে ওঠে রাস্তায়। বাজারে দোকানে আচমকা এসে পড়া কাশফুল জানান দেয় বিশ্বকর্মা পুজোর খবর।

এই দিনটা থেকেই যে পুজো শুরু হয়ে যায় এই পল্লীতে। সঙ্গে আরও চলে আরও এক উৎসবের উল্লাস। তবে এই উৎসব হেঁশেলে। উৎসবের নাম বুড়ো রান্না। রান্না আবার বুড়ো হয় নাকি? নাকি যারা রান্না করে তারা সবাই বুড়ো এ নিয়ে চলতেই থাকে ছেলেমানুষী কৌতুহল কিন্তু ফি বছর বিশ্বকর্মা পুজো আর রান্না পুজো মিলে হাওড়ার ঘরে ঘরে চলে উৎসব।

 

cooking-1

অনেক কলকারখানাতেই পুজোর বোনাস দেওয়া হয় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। বিশ্বক র্মা পুজো য় মিলে যায় পুজোর সুর। সকাল সকাল রান্না পুজোর প্রসাদ খেয়ে পুজোর জামা কাপড় কিনতে যায় মানুষ। সে এক অনাবিল আনন্দ!

রান্নাপুজো হাওড়ার আঞ্চলিক উৎসব। রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও দেখা যায়। কিন্তু বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বুড়ো রান্নার মেজাজ মিলে বদলে যায় গোটা শিল্পাঞ্চলের ছবি। 

 

ভাদ্রে রান্না আশ্বিনে খাওয়া

 

আষাঢ়-শ্রাবণের অঝোর ধারায় ভরে ওঠে খালবিল। উৎপাত বাড়ে সর্পকুলের। তাই সাপের কবল থেকে বাঁচার জন্য ভাদ্র মাসে মনসা দেবী হাওড়া জেলায় পূজিত হন বিশেষভাবে। এই পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষরা অরন্ধন উৎসবে মেতে ওঠে। এই উৎসবকে পান্তা পরবও বলা হয় আদর করে। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন মা মনসাকে উৎসর্গ করে তবে খাওয়া। আগে তিথি অনুযায়ী, আশ্বিন পড়লে তবে সে খাবার মুখে তুলতেন গৃহস্থ।

দেবীকে নিবেদিত নৈবেদ্য সবই রান্না করা। এই সময়ের মনসা পুজোর নাম তাই ‘রান্না পুজো’। এই রান্না পুজোর আবার একাধিক নাম আছে- ইচ্ছা রান্না, গাবড়া রান্না বা আটাশে রান্না, বুড়ো রান্না ও ষষ্ঠী রান্না। সব রান্নার নিয়মকানুন মোটামুটি এক। পার্থক্য শুধু সময়ে।

cooking-4

বুড়ো রান্না প্রতি বছর বিশ্বকর্মাপুজোর নির্দিষ্ট দিনে হয়। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন রান্না আর সংক্রান্তির দিন পান্না উৎসব চলে। মাসের শেষ দিনে হয় বলে এই রান্নার নাম- ‘বুড়ো রান্না’। বুড়ো রান্নার পান্নার দিন বিশ্বকর্মা পূজা হয়। সেকারণে বুড়ো রান্না বড় উৎসবের মর্যাদা পায়।

ভাদ্র মাসের যে কোন শনিবার ও মঙ্গলবার সাধারণ ভাবে ইচ্ছে রান্না পুজো হয়। তবে কিছু কিছু জায়গায় সোমবার ও শুক্রবার রান্না পুজো পালন করেন গৃহিণীরা। ইচ্ছেমতো দিন ঠিক করে রান্না পুজো করে, তাই নাম ‘ইচ্ছা রান্না’।

সূর্য ডোবার পর থেকে রান্নার শুরু আর সূর্য ওঠার আগে তা শেষ করতে হয়। আবার দুই দিন আলাদা ভাবেও অনেকেই পুজো করে। বংশপরম্পরায় সেভাবেই হয়ে থাকে।

রান্না পুজো ব্যয় সাপেক্ষ আয়োজন। ধনী ও মধ্যবিত্তরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আয়োজন করে। দরিদ্র অসহায় মানুষ ধামা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাধুকরী করে দেবীর পুজোর জোগাড় করে। তাঁরা বলেন ‘মা মনসার আয়োজন’।

গ্রামে রান্না পুজোর জন্য নতুন মাটির উনুন তৈরী হয়। অত্যন্ত শুদ্ধাচারে এই পুজো করা হয়।

সূর্য ডুবলেই মাটির নতুন হাঁড়িতে চাল ও জল দিয়ে উনানে বসিয়ে তাতে সিঁদুর মাখিয়ে, নমস্কার করে, শঙ্খধ্বনি দিয়ে আগুন দেওয়া হয়। এটি ভোগের হাঁড়ি। নতুন বস্ত্র পরে বাড়ির গৃহিণী এটি রান্না করে। রান্না চলাকালীন কেউ কথা বলতে পারে না বা অন্যত্র যেতেও পারে না। মাটির খুরিতে ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। তবে রান্নার পুজোর পদ নিয়েও আছে নির্দিষ্ট নিয়ম। ভোগে মাছ থাকে। তবে তা নিরামিষ। পাঁচ রকম ভাজা, চালতার চাটনি বা চালতা-নারকেল দিয়ে মুগ ডাল, মটর ডালের চচ্চড়ি, কচুর শাক, ছাঁচি কুমড়ো, ইলিশ মাছ এই উৎসবের প্রধান প্রসাদ। সঙ্গে অবশ্যই পান্তা।

cooking-2

ভাজার মধ্যে থাকে- নারকেল কোরা ও কোঁচানো,  সজনা শাক , চিচিঙ্গে , ঝিঙে, ঢেঁড়স, বেগুন,ওল,আলু, শশা,কুমড়ো, চালকুমড়ো , কাঁচকলা, পেঁপে, উচ্ছে, করলা এগুলো আবশ্যিক। অনেকে ইচ্ছানুযায়ী আরও আনাজ ভাজে।

 ডাল – কেবলমাত্র খেঁসারির ডালই রান্না হয়। এটি চালতা দিয়ে বানানো হয়। আমড়াও দেন অনেকে  তবে অনেক পরিবারে মুসুর ডালও করে।

তরকারি- পুঁইশাকের তরকারি, নারকেল সহযোগে চালকুমড়োর তরকারি, নারকেল সহযোগে সারকচুর ডাটার তরকারি আবশ্যিক।

 ঝাল- মাছের ঝাল, ইলিশ মাছের ঝাল, চিংড়ির পদ থাকে। তবে সাধ্যমত কাটাপোনা বা পুকুরের মাছ , যাদের যা প্রথা সেই অনুযায়ী মাছ রান্না হয়।

অম্বল- পাকা তেঁতুল, কুমড়ো, ঢেঁড়স, চিংড়ি মাছ বা ইলিশ সহযোগে অম্বল। অথবা চুনোমাছ দিয়েও হয়।

পায়েস আর পিঠেও রান্না করা হয়।

গভীর রাত পর্যন্ত চলে রান্না। সবজি কাটা থেকে শুরু করে রান্না শেষ হোয়া পর্যন্ত কোনও কথা বলতে পারেন না রাঁধুনি। বাড়ির গৃহিণী এবং মহিলা সদস্যদের সাধারণত এই ভূমিকায় দেখা যায়।  রান্না শেষ হলে সমস্ত রান্নাকে একটি পরিষ্কার ঘরে রেখে ভোগের হাঁড়িতে জল দিয়ে পান্না করা হয়। সূর্য ওঠার পর ওই ঘরের একটি কোণে মনসা গাছ পুঁতে রান্নার ভাত তরকারি দুটি পাথরের থালায় সাজিয়ে মনসা গাছের দুই দিকে এবং মাঝখানে চাল,কলা ও দুধের পাত্রটি রেখে মনসা দেবীর পুজো করা হয়। পুজোর প্রসাদ সমস্ত রান্নার মধ্যে মেশালেই রান্নাটি প্রসাদ হয়ে ওঠে।

এই অরন্ধন উৎসবে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী সকলের আমন্ত্রণ থাকে। এদিনের অনুষ্ঠানের নাম ‘পান্না’। আগের দিন রান্না করা প্রসাদের ভাত, সমস্ত ভাজা, তরিতরকারি, পায়েস পর্যন্ত পরের দিনের জন্য খানিকটা করে তুলে হয়। পরের দিনের অনুষ্ঠানের নাম তাই ‘টক পান্না’।

cooking-3

অনেকে পান্তা ভাতের আমানিকে পরিষ্কার শিশির মধ্যে রেখে মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। এইভাবে এক ভাদ্র থেকে আরেক ভাদ্র পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়। বিশ্বাস আছে পুজোর পান্তার আমানিকে গাছে দিলে গাছের বন্ধ্যাত্ব ঘোচে। তিন দিনের এই পান্তা পরবটি এ জেলার মানুষের কাছে একটি বড় ধরনের আনন্দ উৎসব।

দেবীপক্ষের আগে এটিই বাঙালির শেষ উৎসব। এর পরের উৎসবের পর্ব শুরু হয় আবার মহালয়ার পর থেকে। শাস্ত্রমতে, সুপর্বে। দেবী দুর্গার আগমনী প্রহর শুরুর পরেই বাঙালি আবার উৎসবমুখী হয় বলেই দুর্গার অপর নাম ‘সুপর্বা’।

সময় বদলেছে। জেলার ছবিও বদলেছে। কিন্তু নিজস্ব উৎসব সংস্কৃতির এই ধারা আজও বয়ে চলেছে একই স্রোতে। সর্প ভয় থেকে মুক্তি পেতে যে পুজো উৎসবের আয়োজন তা আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মীয় স্বজনদের মিলন উৎসবে। এক কালে বিষধর সাপের কামড় থেকে বাঁচত যে পুজোর শুরু আজ তা বাঙালির অন্যতম সেরা খাদ্য উৎসব।   

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...