চন্ডী মাতা ঘাঘর বুড়ি লৌকিক জনশ্রুতি সবই কি ঠিক?

"চন্ডী" বা "চন্ডিকা" দেবীর উল্লেখ মেলে মার্কন্ডেয় পুরাণের ৮১তম থেকে ৯৩তম অধ্যায়ে, এই তেরো টি অধ্যায়কে "দেবীমাহাত্ম্য" বা "শ্রীশ্রীচণ্ডী" অধ্যায়ও বলা হয়। চন্ডী বা চন্ডিকা নামের অর্থ প্রচন্ড শক্তিশালী। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী, চন্ডী ব্রহ্মশক্তি বা পরমব্রহ্ম মহিষী। জ্ঞান, ইচ্ছা, ক্রিয়া -এই ত্রিশক্তির সমষ্টিভূত রূপ দেবী চণ্ডী।

অন্যমতে, মহাযোগ নিদ্রায় অভিভূত বিষ্ণুর উপদ্রবকারী মহাদৈত্য মধু কৈটভকে নিধনের জন্য বিষ্ণুর মহাযোগ নিদ্রা থেকে মুক্ত হলেন এবং সেই যোগনিদ্রা থেকে উৎপত্তি হল মহাকালী রূপ। নিধন হল মধুকৈটভ। পরে শুম্ভ নিশুম্ভর সেনাপতি চন্ড মুন্ড উৎপাত আরম্ভ করলে মহাক্রোধান্বিতা দেবীদেহ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রূপ ধারণ করে, তার ললাট থেকে নির্গত হয় করালবদনা কালী, প্রবল যুদ্ধে চন্ড এবং মুণ্ডকে বধ করে সেই মস্তক উপহার দিলেন দেবীকে। যে দেবীর ললাট থেকে করালি কালী আবির্ভূতা হয়েছিলেন সেই দেবী চণ্ডিকা নামে পরিচিত।

wdsdsd

রাঢ় বঙ্গে লোকপ্রিয় দেবী চণ্ডী মূলত বৌদ্ধ দেবী চুন্ডা-রই নামান্তর। এই রাঢ় বঙ্গের এক জাগ্রত দেবী ঘাঘর বুড়ি কে চন্ডীর এক রূপ বলে কল্পনা করা হয়।

১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মসনদে তখন নবাব আলিবর্দী খাঁ। পঞ্চকোট রাজ্যে তখন শত্রূঘ্নশেখর - গড়ুরনারায়ন সিংহদেওয়ের রাজত্ব। সেই সময় বারবার বর্গীহানায় বিধস্ত বাংলা। এই হানা থেকে রেহাই মেলেনি পঞ্চকোট রাজ্যের । সে সময় পঞ্চকোটের রাজা গড়ুরনারায়ন সিংহদেও তার সৈন্যবাহিনী ও রাজ্যবাসীকে বর্গীহানা প্রতিরোধ করতে আহ্বান জানান। সৈন্যবাহিনীর দুই বীর ক্ষত্রিয় যোদ্ধা নকড়ি রায় ও রামকৃষ্ণ রায় স্থানীয় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজন নিয়ে বর্গীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নকড়ি ও রামকৃষ্ণ রায়ের বীরত্ব, দুরদর্শিতা সর্বোপরি স্বদেশপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে রাজা গরুড়নারায়ন তিনশত ছিয়াত্তর টাকা চার আনা দু'পাই জমায় তাদের আসানসোলের বিস্তীর্ণ বনভূমির জায়গীর দান করেন। জায়গীরদারদ্বয় আসন গাছ কেটে সোল জমির উপর বসতি গড়ে তোলেন। সোল জমির পূর্ব দিকে আসন গাছের নাম জুড়ে বসতির নাম রাখেন আসানসোল গ্রাম। যাকে ঘিরে বর্তমান আসানসোলের ব্যাপ্তি। জায়গীরদার নকড়ি ও রামকৃষ্ণ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সাঁওতাল প্রজাদের প্রিয় দেবী ‘ঘাঘরবুড়ীর ' থান’ প্রসিদ্ধি লাভ করলে ধর্মপ্রান মানুষের ভিড় জমতে থাকে। নকড়ি ও রামকৃষ্ণ রায়ের তত্ত্বাবধানে ঘাঘর বুড়ীর থানে মন্দির নির্মান ও নিত্যপূজার জন্য পুরোহিত নিয়োগের চেষ্টা করা হয়।কিন্তু গ্রামস্থ পুরোহিতরা কেহই জঙ্গলাকীর্ণ ঘাঘর থানে এসে নিয়মিত মায়ের পূজো করতে রাজি ছিলেন না। এই ছন্নছাড়া গ্রামগুলোতে যজমানি করতেন এক গরীব ব্রাহ্মণ – কাঙালীচরণ চক্রবর্তী। প্রতিদিন তখনকার নুনিয়া নদী(আজকের শীর্ণকায়, খাল সদৃশ, নুনিয়া নয়) পেরিয়ে ওধারের গ্রামগুলিতে যেতেন পুজো অর্চনা করতে, আবার পদব্রজে নদী পেরিয়ে ফিরে আসতেন নিজ বাটিতে। এইভাবেই বহুকষ্টে দিন গুজরান করতেন। কিন্তু তবুও তো সংসার চলে না। এরকমই এক শীতের দিনে – দিনটি ছিল ১লা মাঘ, যজমানের ঘরে পুজো করে সেদিন কিছুই পাওয়া যায়নি। নুনিয়া নদী পেরিয়ে এসে ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত কাঙালীচরণ এক গাছতলার শীতল ছায়ার নীচে শুয়ে পড়লেন। কাতরভাবে ডাকতে লাগলেন মা চণ্ডীকে।

কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ কীসের আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। এই জনহীন প্রান্তরে কে যেন লাঠি ঠুক ঠুক করে আসছে। বুঝতেই পারেননি যে এত বেলা হয়ে গেছে। যখন জেগে ছিলেন তখন সূর্যদেব মাথার ওপরে ছিলেন, আর এখন প্রায় অস্তাচলে। কিন্তু বাঁশের লাঠির ঠুক ঠুক ছাড়া তো আর কোনো শব্দও শোনা যাচ্ছে না। নুনিয়া নদীর গর্জনও থেমে গেল কী করে, আশ্চর্য!

একি! দিনের আলো তো এখনও আছে, অথচ কিছুটা জায়গা একদম অন্ধকার কেন? তবুও তো সেই অন্ধকারের মধ্যে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে – এক ঘাগরা পরিহিত বুড়ি ঠুক ঠুক করতে করতে বাঁশের লাঠি নিয়ে ওঁর দিকেই তো এগিয়ে আসছেন। সেই বুড়ি কিছু না বলে কাঙালীচরণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঙালীচরণের চোখ যেন ঝলসে গেল, সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ ঝলক বয়ে গেল। ব্যস, আর কিছু মনে নেই। ঘুমের অতলে ডুবে গেলেন। ঘুমের মধ্যেই দেখলেন সেই বুড়িকে আবার। পরিষ্কার শুনতে পেলেন – 'তোর আর উঞ্চবৃত্তির দরকার নেই, তোর কোলেই দেখবি তিনটি ছোট পাথরের ঢিবি রেখে এসেছি। মাঝখানে আমি– মা ঘাগরবুড়ি, আমার বাঁয়ে মা অন্নপূর্ণা, ডাইনে পঞ্চানন মহাদেব। এইখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা কর, আর কোথাও যেতে হবে না।' তারপর গাছতলায় পুজো শুরু হয়, পরবর্তীতে মন্দির হয়।

আসলে বুড়ি হিসাবে কল্পনা করে তাকে কিছুটা মাতৃ বন্দনায় পুজো করা হয়। আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে মাতৃ রূপের সঙ্গে শক্তি রূপের মিল আছে। বলা দরকার অতিবৃদ্ধা মাতা হিসেবে পৃথিবী বা প্রকৃতিমাতৃকার উপাসনা আমাদের তন্ত্রধর্মে বলে শুধু নয়, সারা পৃথিবীরই মাতৃধর্মের একটি প্ৰচলিত বিধি। আসানসোল সংলগ্ন সাঁওতাল পরগণায় বুড়ি অন্তনামের অনেক মাতৃদেবীর সন্ধান পাওয়া যায়: কিলাবুড়ি, সাতাইবুড়ি, নুনাবুড়ি প্রভৃতি। আমাদের শিশুরঞ্জক রূপকথায় যে জুজুবুড়ি, তিনিও এরকমই মাতৃকার একটি নেতিবাচক রূপান্তর, এলিটশ্রেণী দ্বারা বিড়ম্বিত চিত্র। যদিও ঘাঘর বুড়ি সম্পর্কে এই বিড়ম্বনার কথা উঠে আসতে পারে। যেমন আগে দেবীর পুজো করতো প্রান্তিক মানুষেরা। পরবর্তীতে দেখা গেল ব্রাহ্মণদের হাতে পুজোর ভার উঠল।

একটা প্ৰচলিত তত্ত্ব হল, ঘাগর শব্দটি ঘাগরা থেকে এসেছে, ঘাগরা পরিহিত এক বৃদ্ধার রূপে মা চণ্ডীর এখানে নাকি আবির্ভাব ঘটেছিল সপ্তদশ শতকে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ কাঙাল চক্রবর্তীর সম্মুখে। বৃদ্ধা এই তিনটি শিলা দেখিয়ে পুজো করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে ঘাগর বুড়ি নাম, এরকম একটি কাহিনী প্ৰচলিত। কিন্তু ঘাগর শব্দটির মূল অর্থ এক প্রকার বাদ্য। সেই ছড়াটা স্মরণ করুন: আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, ঢাক মৃদঙ্ ঘাগর বাজে।

মা ঘাগরবুড়ির আদেশে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৬২০ সালে।এই পাথরের ঢিবিগুলিকেই ফুল এবং রুপোর গয়নায় সাজানো হয়। আর সেই ১৬২০ সালের ১লা মাঘকে স্মরণ করে প্রতি বছর মন্দিরের সামনের মাঠে বসে ঘাগরবুড়ি চণ্ডীমাতার মেলা।

আসানসোল মহকুমা যেমন কয়লা ও ইস্পাত শিল্পের জন্য বিখ্যাত তেমনি বিভিন্ন জাগ্রত দেব-দেবীর আর্শীবাদ পুষ্ট ও মহিমা মন্ডিত। আসানসোল শহরের উত্তরে ক্লেদবাহী শীর্ণকায় নুনীয়া নদীর তীরে অধিষ্টিতা রাঢ় বাংলার জাগ্রত দেবী মা শ্রীশ্রী ঘাঘর বুড়ি।

কে এই ঘাঘর বুড়ি? কি ভাবে এখানে প্রতিষ্ঠিতা হলেন? ইতিহাস বলছে কাশিপুর মহারাজার রাজ্য সীমানা ছিল আসানসোল পর্য়ন্ত। জমি জমার পুরানো রেকর্ড থেকে (সি এস) দেখা যায় তদনীন্তন কাশীপুর মহারাজের নাম।

প্রমাণ্য তথ্য থেকে জানা যায়, বহু প্রাচীন কাল থেকে অনাচ্ছাদিত মন্দিরে, গাছ তলায় পুজা হয়ে আসছে মা ঘাঘর বুড়ির। (বর্তামানে নির্মিত মনোরম মন্দির)। ইনি দেবী শ্রীশ্রী চন্ডী। কোন মূর্তি নেই। শুধু তিনটি শীলা। ঘাঘর শব্দের অর্থ হল – ঝাঁজ বাদ্য ও ঘুঙুর। পুরাণে দেব-দেবীর বিভিন্ন পুজা পদ্ধতির উল্লেখ  আছে- তার মধ্যে নৃত্য গীত-বাদ্য সহকারে বহু দেবীর পূজার প্রচলন ছিল। সেরকমেই এক লোকিক  দেবী  ঘাঘর বুড়ি, যাকে নিয়ে অলৌকিক সব জনশ্রুতি প্রচলিত। তাঁর মন্দির নিয়ে বহুরকম তত্ত্ব ও তথ্য খাড়া করা হয় তবে কোনটা সত্য সেই বিষয়টি আজও অচেনা। তবে অচেনা জিনিসর মতো এর প্রতি আকর্ষণ রয়ে গেছে অগণিত ভক্তবৃন্দের।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...