রুক্ষ হেমন্তে অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মীর আবাহনে গারসি সংক্রান্তি

রুক্ষ হেমন্তে অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মীর আবাহনে গারসি সংক্রান্তি

কেউ বলেন গাস্বী ব্রত কেউ বলেন গারু সংক্রান্তি। লোক চলতি ভাষায় গারসি। পূব বাংলার লোক সংস্কৃতিতে অত্যন্ত প্রাচীন এই ব্রত। আশ্বিনের শেষ দিনে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে অলক্ষ্মীকে বিদায় জানিয়ে লক্ষ্মীর আহ্বান করেন মহিলারা।

গারসি সংক্রান্তির দিন ভোরবেলা ঘটি বা গাড়ু ভর্তি জল বসিয়ে রাখা হয় বাড়ির উঠোনের ঠিক মাঝখানে। জলের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া হয় সর্ষের তেল। গাড়ুর সামনে প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয়। বাড়ির মহিলারা ছোট ছোট পাটকাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে বাড়ির বাচ্চাদের হাতে দেন। একসঙ্গে অলক্ষ্মী দূর হওয়ার গান গাওয়া হয়।

"আশ্বিন যায় কার্তিক আসে
মা লক্ষ্মী ঘরে আসে"।

তারপর সেই পাটকাঠি ফেলে দেওয়া হয় বাইরে। এ হল অলক্ষ্মী বিদায়ের আচার।

তবে গারসি ব্রত একাধিক আচার আছে। স্থান ভেদে বদলে যায় আচার। হিন্দু এবং ইসলাম দুই সম্প্রদায়ের মানুষই গারসি ব্রত পালন করে থাকেন।

আগের দিন বেটে রাখা হয় নিমপাতা আর হলুদ। বাড়ির গিন্নি নিম-হলুদ মেখে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে হাতে ছোলা মটর গুড়, হলুদ, ও তেঁতুল এর টুকরো নিয়ে উঠোনের ঘটে প্রণাম করেন এবং বলেন,

“আশ্বিন যায়

কার্তিক আসে

লক্ষ্মী ঠাকরুন গর্ভে বসে”।

তারপর শুরু হয় গারসি রান্না পর্ব। এই ব্রত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রান্না। খেসারির ডালের মধ্যে কচু, থোড়, শাপলা আর নানা সবজি দিয়ে রান্না করা হয় গারসি ডাল। এই দিনের বিশেষ। সঙ্গে থাকে কচু শাক, কচু ভাজা। সারাদিন নিরামিষ। মশলা, ফোড়ন, সর্ষের তেল খাওয়া মানা। খেসারির ডালের বদলে অনেকে মটর বা মুগ ডাল দিয়েও এই গারু ডাল রান্না করা যায়। বাংলার মাঠে ঘাটে যত ধরনের কচু পাওয়া যায় সবই গারসি ডালের আবশ্যিক উপাদান।
সিলেট অঞ্চলে এই ব্রতটিকে আট আনাজের ব্রত বলে। সংক্রান্তির দিন আট রকমের আনাজ দিয়ে ডাল রান্না করে মাটির হাঁড়িতে রেখে দেওয়া হয় ও পর দিন ভোরে মানে পয়লা কার্তিক খাওয়া হয়। 

গারসি ব্রতে বাড়ির কর্ত্রী প্রধান। ভোরবেলা গারু পুজো থেকে শুরু করে প্রদীপ দান সবেতেই স্ত্রী আধিপত্য। এ প্রসঙ্গে একটি লোককাহিনী শোনা যায় বিপত্নীক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ আহ্নিককালে কুচিন্তা করেছিল। ফল হিসেবে সেই গৃহে অলক্ষ্মী প্রবেশ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ব্রাহ্মণের পুত্রবধূ ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠাবতী। তাই অলক্ষ্মী গৃহে পদার্পন করতে পারে না। লক্ষ্মী অচঞ্চলা হন ব্রাহ্মণের গৃহে। সেই সূত্রেই গারসি ব্রত হয়ে ওঠে মাতৃতান্ত্রিক। অনেক অঞ্চলে পুত্রবধূ এই দিন মৃতা শাশুড়ির উদ্দ্যেশ্যে জলদান করে।

বারসি ব্রত অন্যদিকে কৃষির উৎসব। হেমন্ত শুখা মরসুম। শস্য কিংবা আনাজ কোনটাই সেভাবে পাওয়া যায় না। সেই শুষ্ক, রুক্ষতাকে দূর করে ঘরে যাতে লক্ষ্মী পায়ের ছাপ পড়ে তার জন্য গারসী ব্রত পালন করে মানুষ। রোগ, মারী, কীটপতঙ্গ প্রতিকারের যাচনা থাকে আবাহনে।    

সন্ধ্যেবেলায় জ্বালা হয় আকাশ প্রদীপ। পূর্বপুরুষদের উদ্দ্যেশ্যে আলো দেখানোর জন্য আশ্বিনের শেষ দিন থেকে কার্তিকের শেষ দিন পর্যন্ত জ্বলতে থাকে এই আলো।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...