একটি তথ্যচিত্রতে ধরা পড়েছিল তিন সংগীত মায়েস্ত্রো- আলীউদ্দিন খান, আলী আকবর খান, রবিশংকর একইসঙ্গে বসে বাজাচ্ছেন নিজেরদের মনের সুর। তিনজন তিনভাবে আগলে রেখেছেন নিজেদের সুরের কাঠামো। অথচ একই নিমগ্নতার ছায়া পড়েছে তিনজনের অবয়বে। সে দৃশ্য প্রকৃতই প্রকৃতিজাত শিল্পের উৎকৃষ্ট সরঞ্জাম। উস্তাদ আলাউদ্দীনের দুই কৃতি সন্তান, একজন ঔরজ আলী আকবর খান এবং দ্বিতীয়জন আত্মজ রবিশংকর।
বাবা আলাউদ্দীনের তৈরী মাইহার ঘরানার হিন্দুস্তানী রাগসঙ্গীতের বিখ্যাত সরোদ-শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান জন্ম নেন ১৯২২ সালে , ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়। কিন্তু শিশু বয়সেই বাবার কর্মস্থল মাইহার (এখনকার মধ্য প্রদেশ) চলে যান। সঙ্গীতের যেটুকু শিক্ষা তা সঙ্গীতজ্ঞ বাবার কাছেই। একটা নয় ছোটবেলা থেকে নানান বাদ্যযন্ত্র বাজানোর পর শেষে সরোদই ওঁর সঙ্গী হয়। সেই সময়ে আরও অনেক বিখ্যাত শিল্পীই সঙ্গীত শিক্ষাগুরু আলাউদ্দীনের কাছে সঙ্গীত শিখতেন - পান্নালাল ঘোষ (বাঁশী), তিমির বরণ (সরোদ), বোন রোশনারা খান - পরে রবিশঙ্করকে বিয়ে করে অন্নপূর্ণা দেবী (সুরবাহার) এবং রবিশঙ্কর (সেতার)।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে আলী আকবর এলাহাবাদে এক সঙ্গীত সম্মেলনে আত্মপ্রকাশ করেন। কয়েকবছর বাদে সেখানেই রবিশঙ্কর এবং উনি যৌথভাবে যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন। আলী আকবরের সরোদ আর রবিশঙ্করের সেতার। ১৫ বছর বয়সে অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে বাজানোর সুযোগ পান। ২১ বছর বয়সে বাবার আশ্রয় ছেড়ে পেশাদার সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে ভাগ্য অন্বেষণে বেড়িয়ে পড়েন। কিছুদিনে রেডিওতে চাকরি করে, পরে মহারাজ জোধপুরের রাজসভায় কিছুদিন বাজিয়ে উনি পাড়ি দেন মুম্বাই। সেখানে বেশ কিছু চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান। ওঁর সুরারোপিত ছবির মধ্যে কিছু বাংলা ছবিও ছিল, যেমন সত্যজিত্ রায়ের 'দেবী' এবং তপন সিংহের 'ক্ষুধিত পাষাণ'। মার্চেণ্ট আইভরির 'দ্য হাউসহোল্ডার' ছবির সুরারোপও করেছিলেন আলী আকবরই। ১৯৫৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত বেহালাবাদক ইহুদী মেনুহিন-এর আমন্ত্রণে আমেরিকায় যান। ফিরে এসে ১৯৫৬ সালে কলকাতায় 'আলী আকবর কলেজ অফ মিউজিক' প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭১ সালে মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশে'-এ রবি শংকর, আল্লারাখা ও কমলা চক্রবর্তীর সঙ্গে ছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খানও। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্যবাসীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে যাঁদের বিশেষ ভূমিকা আছে, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। সারা বিশ্বে তিনি রাগসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন - কখনো একা, কখনো যৌথভাবে।
প্রথমদিকে যুগলবন্দি করতেন রবিশঙ্করের সঙ্গে। পরে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, এল. সুব্রাহ্মনিয়াম এবং কয়েকবার বিলায়েত্ খানের সঙ্গেও ওঁকে বাজাতে দেখা গেছে। রাগসঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রেও আলী আকবর তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ওঁর নিজের সৃষ্টি একটি মিশ্র রাগ 'চন্দ্রনন্দন' সঙ্গীতমহলে খুবই জনপ্রিয়।
অনেক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন আলি আকবর৷ ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মভূষণ এবং পদ্মবিভূষণ পেয়েছেন তিনি৷ পেয়েছেন লন্ডনের মহাত্মা গান্ধী কালচারাল অ্যাওয়ার্ড, বিল গ্রাহাম লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট, ১৯৯৫ সালে এশিয়ান পেইন্টস-এর সম্মানজনক শিরোমণি অ্যাওয়ার্ড৷ ১৯৯৬ থেকে ৯৮ পরপর তিন বছর তাঁর সঙ্গীত গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে৷ এসবের বাইরে স্বদেশ আর বিদেশে অসংখ্য ছোটবড় সম্মান আর পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন শিল্পী আলি আকবর খান৷
সঙ্গীত, বিশেষত ভারতীয় মার্গসঙ্গীত প্রসঙ্গে একটি বড় প্রিয় বাক্যবন্ধ ছিল খান সাহেবের। বলতেন, 'আশৈশব জানি, সঙ্গীত আমাদের কাছে, আমার পরিবারের কাছে জীবনযাপনের অতি প্রয়োজনীয় আহরণ৷ এ আসলে আমাদের খাদ্য৷ যাকে বাদ দিয়ে জীবনধারণ অসম্ভব৷ যখন সেই খাদ্যের প্রয়োজন তোমার হবে, সেই মুহূর্তে তুমিও বুঝবে, এ তোমার হৃদয়ের কতখানি৷'
একবার এক জনৈক সংবাদপত্রে পড়েছিলাম আলি আকবর খান সাহেবের বহু দিনের বন্ধু বিমান ঘোষ (তখন এইচ এম ভি-র এক কর্তা) শান্তিনিকেতনের ট্যুরিস্ট লজের একটা ঘরে বসে তাঁকে বারবার বলছিলেন বাংলায় একটা আত্মজীবনী করার জন্য। আত্মমগ্ন সুরে খান সাহেব বলেছিলেন, ‘‘যা সরোদে বলতে পারিনি, তা কি মুখে বলতে পারব?’’ ২০০৯ সালের আজকের দিনে(১৮ জুন) পরমলোকে চলে যান সু্রসাধক- উস্তাদ আলী আকবর খান আর অনাগত কালের জন্য রেখে যান তাঁর জীবনের শ্বাশ্বত সুর।