আলবার্ট হল কিন্তু শুধু লন্ডনেই নেই, তার অস্তিত্ব আছে খোদ কোলকাতাতেও। তবে আত্মগোপন করে - তা অনেকের অজানা আর নিশ্চিত করে বলা যায় এ প্রজন্মের অধিকাংশই সে বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। আজ সে গল্পই হবে।
উত্তর কলকাতার বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট এবং বৈঠকখানা রোডের সংযোগস্থলে আরো স্পষ্টত কলকাতার বই পাড়ায় অর্থাৎ কলেজ স্ট্রীটে আজকের বিখ্যাত কফি হাউসের বাড়িটি ছিল মহান বাঙালি দার্শনিক এবং সমাজ সংস্কারক শ্রী কেশব চন্দ্র সেনের বাসস্থান। পরে এটি ওয়েলসের যুবরাজ অ্যালবার্ট ভিক্টরের (ডিউক অফ ক্লারেন্স) সম্মানে "অ্যালবার্ট হল" নামকরণ করা হয়েছিল ১৮৭৬ সালের এপ্রিল মাসে।
আজও রাস্তার পাশে লাগানো বোর্ডটা ভালো করে লক্ষ্য করলে খুব ছোট্ট করে এই সুপ্ত পরিচয়টির সন্ধান পাওয়া যাবে। এই কফি হাউস ছিল কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, হিন্দু কলেজের (যা আজ প্রেসিডেন্সি) উজ্জ্বল ছাত্রদের জ্ঞানের আদানপ্রদান ক্ষেত্র, সাথে ছিল সাধারণ মানুষের আড্ডাস্থল। কে আসেননি এখানে? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ আরো বেশ কিছু ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের গঠনমুলক আলোচনার ক্ষেত্রস্থল ছিল এই বাড়িটি। সুতরাং এর সাথে ঐতিহ্য ও ইতিহাস দুই-ই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আরো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো ১৮৮৫ সালের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বার্ষিক সম্মেলন এখানে হয়। নেতাজিও একাধিক রাজনৈতিক সভা করেছেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বেশ কিছু পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে এখানেই করেন নেতাজি। তবে তখন এটি আলবার্ট হল হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু আড্ডা, সমাবেশ তো আর শুধু মুখে হয় না। বাঙালির আড্ডা কিন্তু পূর্ণতা পায় চা এর সাথে। সাহেবিয়ানার সাথে বাঙালিয়ানার মেলবন্ধন ঘটাতে ১৯৪২ সালে কফি বোর্ড অ্যালবার্ট হল থেকে একটি কফি জয়েন্ট শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে এই বাড়ি আড্ডার পীঠস্থান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার জায়গাটির নাম"কফি হাউস" করে দেয়।
জায়গাটি কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের ব্যক্তিত্বদের এক মিলনস্থলে পরিণত হয়। ১৯৫৮ সালে ম্যানেজমেন্ট কফি হাউসটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু ঐতিহ্যবাহী স্থানটি বাঁচানোর জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সরকারের কাছে একটি বিশেষ আর্জি জানালে তা আবার চালু হয় । যাইহোক, শ্রমিক সমিতি তাদের নিজস্বভাবে তা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং তখন থেকেই "ইন্ডিয়া কফি বোর্ড ওয়ার্কার্স সমবায় সমিতি লিমিটেড" এর পরিচালনা করতে থাকে । জরাজীর্ণ সিঁড়ি, শত বছরের পুরনো লেটার বক্স, জং ধরা, ঘুণে ধরা প্রাচীন আমলের বৈদ্যুতিক মিটারের সংস্কার প্রয়োজন ছিল যদিও এখনো আছে । কিন্তু ২০০৬ সালে একটি বিশাল আর্থিক সঙ্কট সমবায় সমিতিকে কফি হাউস সংস্কারের কাজ থেকে বিরত রাখে । এশিয়ান পেইন্টসের মতো কয়েকটি সংস্থা রেস্তোঁরাটি সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে সমবায় সমিতির কাছে পৌঁছলে নিয়ম এবং শর্তের সংঘাতের কারণে অফারগুলি প্রত্যাখ্যান করা হয় ।
কফি হাউস আর কলেজ স্ট্রিট সমার্থক। কারণ, কলেজ স্ট্রিট যেমন বইয়ের প্রাণ, তেমনি কলেজ স্ট্রিটের প্রাণ এই কফি হাউস। তাই তো দেশ-বিদেশের বিদ্বজ্জনেরা এখনো কলকাতায় এলে পা রাখেন এই কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে। সময়ের সাথে খাবারের তালিকাতেও এসেছে একাধিক সংযোজন - মোগলাই, চীনেখাবার সবই স্থান পেয়েছে। আর পরিবর্তন হয়েছে মার্বেলের টেবিলের। তার জায়গায় এসেছে কাঠের টেবিল। তবে এখানে পা দিলেই সেই ঐতিহ্যের ঘ্রান আজও জানান দেয় তার বনেদিয়ানার। এই কফি হাউসেই প্রতিবছর বইমেলা বসে। সাধারণ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বড় বড় নামজাদা কফি শপের শান্ত পরিবেশ ছেড়ে কিছুটা আড্ডা আর কিছুটা ঐতিহ্যের টানে এখনো ভিড় জমান এখানে। সেও আর্থিক সংকট, প্রতিকূলতা কে উপেক্ষা করে আজও তার অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে স্বমহিমায় ।