ভারতীয় সিনেমার নির্বাক যুগের প্রথম দিকে খাঁ বাহাদুর আরদেশীর ইরানি নামের এক পার্শি ভদ্রলোক ছিলেন বিদেশি ছবির ডিস্ট্রিবিউটার। ফলে, ফ্রান্স-আমেরিকায় সিনেমার কারিগরিতে কি কি উন্নতি হচ্ছে তার খবর তিনি আগাম পেতেন।
সেকালে ছায়াছবির শ্যুটিং-এর সময় অভিনেতারা ডায়লগ বলতেন বটে, কিন্তু তখনও ফিল্মে ছবির সঙ্গে সাউন্ড রেকর্ড করার পদ্ধতি আবিষ্কারই হয়নি। তাই দর্শক ছবি দেখার সময় শুধু অভিনেতাদের লিপ নাড়তে দেখতেন, কোন কথা শুনতে পেতেন না। ছবির মাঝে মাঝে শুধু সাবটাইটেল দেখিয়ে দর্শককে গল্পের খেই ধরিয়ে দেওয়া হত।
প্রথম প্রথম এই নির্বাক ও চুপচাপ ছবি দেখেই দর্শক আশ্চর্য হতেন। কিছুদিন পর ধীরে ধীরে আশ্চর্যের মাত্রা কমতে লাগল। কারণ, এক জিনিস নিয়ে চিরকাল মেতে থাকা মানুষের স্বভাব নয়। ছায়াছবির ব্যবসাদারেরাও ততদিনে বুঝে গেছেন, পাবলিককে ধরে রাখতে পারলে এ-ব্যবসায় বিলক্ষণ লাভ আছে।
অন্যদিকে আর্টের সমঝদার সিনেমাকর্মীরা বুঝলেন সাউন্ডের অভাবেই একটি দৃশ্যের ঠিকঠাক অভিঘাত তৈরি করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, সাউন্ডের বিকল্প হিসেবে প্রতিটি সিনেমা হলে একটি করে অর্কেস্ট্রা দল রাখার রেওয়াজ চালু হল।
দলটির কাজ হল, ছবির সঙ্গে মুড অনুযায়ী লাইভ মিউজিক বাজিয়ে যাওয়া। এতে দর্শক প্রেম, দুঃখ, আনন্দ ও যুদ্ধের আলাদা আলাদা রোমাঞ্চ উপলব্ধি করার সুযোগ পেলেন। ফলে, এই নবতম আকর্ষণে তারা মোহিত হলেন।
ওদিকে মোমের সিলিন্ডার পেরিয়ে গালার ফ্ল্যাট রেকর্ডে যখন গ্রামোফোনের গান রেকর্ড শুরু হল, তখন আলাদা করে তাতে ডায়লগ রেকর্ড করে ছবির সঙ্গে চালিয়ে একটা নতুন কিছু করার বেশ কিছুদিন চেষ্টা চলল; কিন্তু লিপের সঙ্গে ডায়লগ মেলানো নিয়ে শুরু হল দারুণ সমস্যা। সুবিধে বা সুখ কিছুই হল না। ফলে, সে প্রচেষ্টা অচিরেই গঙ্গালাভ করল।
থিয়েটারের টুকরো কিছু দৃশ্য, সভাসমিতি-মিছিলের ছবি দিয়ে বঙ্গে তথা ভারতে হীরালাল সেনের হাত ধরে ছায়াছবির সূত্রপাত। কেউ কেউ আবার এ-কাজে জনক হিসেবে বোম্বের হরিশ্চন্দ্র ভাটভাদেকরের কথা বলেন।
যাই হোক, সেই সব টুকরো ছবির সূত্র ধরে ১৯১৩-তে এসে এদেশের প্রথম কাহিনিচিত্র ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ তৈরি করে ফেললেন দাদা সাহেব ফালকে। সেও দেখানো হল লাইভ অর্কেস্ট্রেশনের মাধ্যমে। সাউন্ড নিয়ে তার বেশি এগনোর প্রচেষ্টা এ-দেশে হল না। কারণ, এ-দেশে যা একবার চালু হয়, তা বাইরে থেকে নতুন কিছু না-আসা অব্দি চলতেই থাকে। ধারার ধারাবাহিকতা এমনই।
ওদিকে ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ১৯২৭-এ আমেরিকায় প্রথম সবাক ব্রিটিশ কাহিনিচিত্র তৈরি হয়ে গেল। সঙ্গীতমুখর সেই কাহিনিচিত্রের নাম, ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’। স্বভাবতই অভূতপূর্ব সাফল্য পেল ছবিটি। এই সফলতা নতুন সিনেমা-টেকনিকের প্রতি আরদেশীর ইরানিকে আগ্রহী করে তুলল।
ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে থাকতে ইরানি বিপণনের আঁটঘাট যেমন চিনে ফেলেছিলেন, তেমনি নিজের উদ্যোগে শিখে নিয়েছিলেন ছবি তৈরির কলাকৃতিও। ১৯২২-এ নির্বাক ছবি ‘বীর অভিমন্যু’ দিয়ে তাঁর চিত্রপরিচালনায় হাতেখড়ি।
১৯২৭-এর অক্টোবরে যখন আমেরিকায় সবাক ছবি ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’ রিলিজ করল, ততদিনে ইরানি আরও সাতখানা নির্বাক ছবি পরিচালনা করে ফেলেছেন। তাঁর ব্যবসায়ী ও শিল্পী মন চাইল এই নতুন টেকনিক এদেশে এনে সব্বাইকে চমকে দিয়ে ইতিহাস তৈরি করতে।
বোম্বের পার্সিয়ান থিয়েটারে জোসেফ ডেভিডের ‘আলম আরা’ নাটকটি তখন মঞ্চ কাঁপাচ্ছিল। এটি আসলে একটি রোম্যান্টিক প্রেমকাহিনি।
সুলতান সেলিম খানের দুই বেগম। দিলবাহার আর নওবাহার। দুজনের কেউই সুলতানকে পুত্র দিতে পারেননি। তাই সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী কে হবেন, এই নিয়ে সুলতানের চিন্তার শেষ নেই।
সুলতানের সভায় একদিন এলেন এক ফকির। তাঁর দোয়ায় নওবাহার জন্ম দিলেন এক শাহজাদার। শাহজাদার নাম দেওয়া হল, জাহাঙ্গীর খান।
উত্তরাধিকারী পেয়ে সুলতানের সব ভালোবাসা গিয়ে পড়ল নওবাহারের ওপর। এতেই বিষিয়ে গেল দিলবাহারের মন। শুরু হল সুলতান ও নওবাহারের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র। সুলতানের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী আদিল খানকে দলে টানতে দিলবাহার প্রেমের অভিনয় শুরু করলেন তাঁর সঙ্গে। কিন্তু সেই ফাঁদে পা না-দেওয়ায়, আদিলকে বন্দী করলেন দিলবাহার।
আদিলের একমাত্র শিশুকন্যা আলম আরা বাড়ি থেকে তাড়িত হয়ে আশ্রয় পেল জিপসিদের কাছে। তাদের আশ্রয়েই সে মানুষ হতে লাগল, বড় হতে লাগল।
হঠাৎ একদিন আলম আরার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল শাহজাদা জাহাঙ্গীরের। প্রথম দেখাতে দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়ল। তারপর শাহজাদার সাহায্যে একদিন আলম আরা বাবাকে বন্দীশালা থেকে উদ্ধার করল, দিলবাহারের মুখোশ খুলে দিল। অবশেষে শাহজাদার সঙ্গে তার বিয়ে হল এবং দিলবাহারের শাস্তি হল। এই হল মোদ্দা গল্প।
এই গল্পের দিকেই চোখ গেল ইরানির। তিনি জোসেফ ডেভিড ও মুন্সী জাহীরের হাতে চিত্রনাট্যের দায়িত্ব দিয়ে নিজে শিখে নিলেন সিনেমার সাউন্ড রেকর্ডিং-এর কৌশল।
সবাক ছবি তোলার এই নতুন পদ্ধতিতে একই ফিল্মে সাউন্ড আর ছবি পাশাপাশি রেকর্ড হয়। নির্বাক যুগের ক্যামেরায় সে সুবিধে নেই বলে নতুন ক্যামেরাও জোগাড় করতে হল। ডাবিং-পদ্ধতি তখনও আবিষ্কার হয়নি।
ছবির জন্য সাতখানা গান বাঁধলেন ফিরোজশাহ মিস্ত্রি আর বি ইরানি—দুজনে মিলে। হিন্দি-উর্দুতে স্ক্রিপ্ট লেখা হয়ে গেল।
ছবিতে শাহজাদার ভূমিকায় নেওয়া হল, তখনকার বিখ্যাত স্টান্টম্যান কাম অভিনেতা মাষ্টার ভিট্টলকে; আলম আরা’র ভূমিকায় নেওয়া হল বিখ্যাত নবাবপরিবারের মেয়ে জুবেদাকে; আদিল খানের চরিত্রে নেওয়া হল পৃথ্বীরাজ কাপুরকে।
স্টুডিওর ভেতর সুলতানের মহল বানানো হয়ে গেল। কিন্তু, ছবির শ্যুটিং-এ নেমে প্রধান সমস্যা হল ডায়লগ টেক করতে গিয়ে। রাজ্যের চিৎকার, চেঁচামেচি, গাড়ির আওয়াজ, হর্ন ডায়লগের সঙ্গে মিশে শট কেঁচিয়ে দিতে লাগল।
আসলে, নির্বাক ছবিতে সাউন্ডের বালাই ছিল না বলে, তখনকার ফিল্ম স্টুডিওগুলো যেখানে- সেখানেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু, সাউন্ড ফিল্মের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত সাউন্ড রেকর্ড হলেই রাজ্যের মুশকিল। তার ওপর যে স্টুডিওতে ‘আলম আরা’র সেট তৈরি হয়েছিল, সেটি ছিল আবার রেললাইনের ধারে। কাজেই বোম্বের রেলের আওয়াজে কিছুতেই সুষ্ঠুভাবে স্যুটিং করা সম্ভব হচ্ছিল না। এবার উপায়?
মুশকিল আসান করতে ট্রেনের শেডিউল ঘেঁটে দেখা হল, মাঝরাত থেকে ভোর অব্দি ট্রেন আর মালগাড়ির ঝামেলা নেই বললেই চলে। সুতরাং, সেই সময়টুকুতেই নিয়ম করে শ্যুটিং চলতে লাগল ‘আলম আরা’র। তখন সিনেমায় প্লে-ব্যাক চালু হয়নি। তাই, গানের সিকোয়েন্সে গান-নাচ সব লাইভ রেকর্ডিং হল। এভাবেই একদিন শেষ হল ছবি।
১৯৩১’এর ১৪ মার্চ, বোম্বের ‘ম্যাজেস্টিক সিনেমা’ হলে মুক্তি পেয়েছিল ‘আলম আরা’। দু’ঘন্টা চার মিনিটের ছবি। পোস্টারে ছবির নামের নীচে লেখা হয়েছিল, ‘অল টকিং, সিঙ্গিং অ্যান্ড ডান্সিং’!
প্রথম আট সপ্তাহ টানা হাউস ফুল চলল। ছবির ‘দে দে খুদাকে নাম পে’ গানটি ফিরতে লাগল সকলের মুখে মুখে। এই ছবি ভেঙে দিল জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ রেকর্ড। ইতিহাস তৈরি করল প্রথম ভারতীয় সবাক ছবি হিসেবে। আর, আরদেশীর ইরানি সিনেমার ইতিহাসে অমর হয়ে গেলেন প্রথম ভারতীয় সবাক ছবির সফল পরিচালক হিসেবে।
কিন্তু...এই ইতিহাস এখন শুধুই পাঠ্য। এর কোন অডিও-ভিজুয়াল নেই। পোড়া দেশ খুঁজে ছবিটির নেগেটিভ তো দূরের কথা, একটা লজঝড়ে প্রিন্টও পাওয়া যায়নি। ‘ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ’ অনেক গবেষণা করেও কিছু জোগাড় করে উঠতে পারেনি।
চেতনাগতভাবে ইতিহাস রক্ষার দায় নিয়ে আদিমকাল পেরিয়ে আমরা খুব একটা এগিয়েছি বলে মনে হয় না। ফ্রান্স-আমেরিকা তাদের তোলা প্রথম ফুটেজটিও প্রিজার্ভ করে রেখেছে। আমাদের নেই। ভারতীয় সিনেমার আদি যুগ আছে শুধুই গল্পে, বিতর্কে আর স্মৃতিতে। সেই তালিকায় ‘আলম আরা’ আর একটি দীর্ঘশ্বাসমাত্র...