বাংলা সিনেমা ও মঞ্চের অবিস্মরণীয় অভিনেতা 'নটসূর্য' অহীন্দ্র চৌধুরী

অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরী নিজেকে ভাঙতে জানতেন, থামতে জানতেন। সেভাবেই তিন দশক ধরে বাংলার পেশাদার নাট্যমঞ্চ ও চলচ্চিত্র জগতে সমানতালে দাপিয়ে অভিনয় করে সম্মানের সঙ্গে অভিনয় জগতকে তিনি বিদায় জানিয়ে সরে এসেছিলেন। এ তো সবাই পারেনা, তিনি পেরেছিলেন। এবং সেটা কায়িক মৃত্যুর দু'দশক আগেই। ১৯৫৭ সালের ২৮ জুন মুক্তি পাওয়া 'নীলাচলে মহাপ্রভু' তাঁর শেষ অভিনীত ছবি। আর এ-বছরই ১১ সেপ্টেম্বর মিনার্ভা থিয়েটারে 'সাজাহান' নাটকে তিনি শেষবারের মতো অভিনয় করেন। এই নাটকে অহীন্দ্র সাজাহানের চরিত্রে অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনয় অসম্ভব পছন্দ করতেন বিধান চন্দ্র রায়, ব্যক্তিমানুষটিকেও অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাই অহীন্দ্রর অভিনয়জীবনের বিদায়ী সংবর্ধনার মঞ্চে সভাপতিত্বের পদ সানন্দে বরণ করেছিলেন তিনি।

নাট্যকার মন্মথ রায় অহীন্দ্রকে 'নটসূর্য' অভিধায় ভূষিত করেছিলেন মঞ্চে তাঁর অভিনয়ের ব্যাপ্তির জন্য। কিন্তু অহীন্দ্র মঞ্চের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি; নিজেকে অত্যন্ত সাবলীলভাবে ব্যাপ্ত করেছিলেন নির্বাক থেকে সবাক সিনেমার আঙিনায়। সেটা কীভাবে ঘটেছিল, সেটাই এখন বলছি:

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক। বাংলা সিনেমা তখন নতুন মাধ্যম। তার তখন নির্বাক যুগ চলছে। অহীন্দ্র ইতোমধ্যে বেশ ক'বছর হল এখানে-ওখানে শখের অভিনয় করে চলেছেন অপেশাদার মঞ্চে। সেই সূত্রে নতুন অভিনয়-মাধ্যমটি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ জাগল। আর ঠিক এই অবস্থায় তাঁর আলাপ হল প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে। বন্ধুত্বও হয়ে গেল। কেননা, প্রফুল্লও সিনেমা সম্পর্কে সমান কৌতূহলী এবং এই মাধ্যমকে জড়িয়ে কিছু একটা করতে আগ্রহী।

ব্যস, দুই বন্ধু মিলে ঠিক করলেন নিজেরা কোম্পানি খুলে ছবি তৈরি করবেন। অল্প সময়ে জুটলেন আরও কয়েকজন সমধর্মী বন্ধু। তাঁদের নিয়েই অহীন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন নিজেদের চিত্র-প্রতিষ্ঠান, 'ফটো প্লে সিন্ডিকেট'।

এটা সেই সময়ের কথা, যখন নিজেদের স্টুডিও থাকলে তবেই ছায়াছবি তৈরি করা যেত; নিজেদের প্রেক্ষাগৃহ থাকলে তবেই সেই ছবি মুক্তি দিয়ে প্রদর্শন করা যেত। অহীন্দ্ররা নিজে অপেশাদার। তাই ঠিক করলেন ক্যামেরা বাদে অভিনয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অপেশাদার মানুষদের নিয়েই কাজ করবেন। আর গড়ে তুলবেন নিজেদের একখানা স্টুডিও। ছবি তো আগে তৈরি হোক, তারপর যেভাবেই হোক তাকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই শুরু হল কাজ। শুরু হল উদ্যোগ।

স্টুডিও তৈরিতে আগে জমি চাই। জমির জন্য টাকা চাই। অহীন্দ্রর বাবা চন্দ্রভূষণ চৌধুরী ভবানীপুরের গৌরীসেন। কিন্তু ছেলে থিয়েটার-অভিনয় করে বেড়ায়--এটা তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়। অহীন্দ্র জানেন যে, চাইলে বাবা একটা টাকাও এ-কাজে দেবেন না। তবু সিনেমা তৈরির অদম্য উৎসাহে আমতা আমতা করে বাবার কাছে গিয়ে কথাটা পাড়লেন একদিন। ছেলে বড় হয়েছেন, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স; তাই বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। তবে এ-প্রসঙ্গে কোন কথাও বললেন। গাছকে বললে যেমন হয়, তিনি তেমনি উদাসীন রইলেন।

দিন গেল। তবু অহীন্দ্র হাল ছাড়লেন না। বন্ধু প্রফুল্লকে পাঠালেন বাবার কাছে। প্রফুল্লর মধ্যে একটা আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতার জোরে তিনি চন্দ্রভূষণকেও গলিয়ে ফেললেন। এবং সকলকে অবাক করে স্টুডিও তৈরির জন্য চন্দ্রভূষণ টাকা দিতে রাজি হয়ে গেলেন।

ব্যস, বেহালা ট্রাম ডিপো ছাড়িয়ে গ্রামের ভেতর জমি কিনে তৈরি হয়ে গেল স্টুডিও। এবার তোড়জোড় চলল ছবি তৈরির। অহীন্দ্র লিখে ফেললেন গল্প ও চিত্রনাট্য। সে-সব শুনে সবার বেশ ভালো লাগল। সর্বসম্মতিক্রমে ছবির নাম দেওয়া হল, বাংলায় 'বাঁদীর প্রাণ', ইংরেজিতে 'সোল অব আ স্লেভ'। সেই যুগে কলকাতা শহরে বিদেশিদের রমরমা, অবঙ্গভাষীদের গুলজার। এবং নির্বাক ছবির একটা সুবিধে এই যে, দর্শক হয়ে এদের কাউকেই ভাষাসমস্যায় পড়তে হত না। শুধু ছবির বিষয়টা নামকরণের মাধ্যমে তাঁদের কাছে পৌঁছে দিতে হত। আর সেজন্যই সে সময় বাংলার পাশাপাশি ছবির একটি ইংরেজি টাইটেলও দেওয়া হত।

যাই হোক, নির্দিষ্ট সময়ে সংস্থার মালিক-কর্মচারী সবাই মিলে অভিনয় করলেন পুরুষ চরিত্রগুলিতে।শুধু নারী চরিত্রে দুজন বিদেশিনীকে টাকাপয়সা দিয়ে কাজ করালেন। ছবিতে অহীন্দ্র অভিনয় করেছিলেন  একেবারে মুখ্য চরিত্রে। সেই চরিত্রের নাম, 'ধর্মপাল'। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

এবার ছবিটি কতটা সফল হয়েছিল, সেকথা বলি:

সেই সময় কলকাতার সিনেমা ব্যবসা একচেটিয়া ছিল  'ম্যাডান থিয়েটার্স'-এর হাতে। তাঁদের প্রচুর প্রেক্ষাগৃহ। তাই অনেক ধরাধরি করে রাজি করিয়ে তাঁদের মাধ্যমেই অহীন্দ্ররা ছবি রিলিজ করলেন ১৯২৩ সালে ১৭ মার্চ। মুক্তির পর ছবিটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, দীর্ঘদিন প্রেক্ষাগৃহে চলছিল তো বটেই, সেই সঙ্গে এক বছর পর দর্শকের অনুরোধে কর্তৃপক্ষ ফের ছবিটি প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এভাবেই চরম সফলতার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল অহীন্দ্রর চিত্রাভিনেতার জীবন। আবার এই ১৯২৩ সালেই স্টার থিয়েটারে 'কর্ণার্জুন' নাটকে অর্জুনের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পেশাদার মঞ্চেও তাঁর অভিষেক হয়। একইসঙ্গে এভাবেই মঞ্চে ও চিত্রে এই বলিষ্ঠ অভিনেতার অভিনয়ে মুগ্ধ হবার সুযোগ পান নাট্য ও চিত্রামোদী দর্শক।

অহীন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান অভিনেতা। মঞ্চ ও চিত্রের অভিনয়ের পার্থক্য তিনি অনুধাবন করেছিলেন; তাই তাঁর অভিনয়ে সেই অনুভবের ছাপ তিনি বজায় রেখেছিলেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটকে সেলুকাস চরিত্রে, 'চিরকুমার সভা' নাটকে রসিক, 'চন্দ্রনাথ' নাটকে অপনভোলা কৈলাসখুড়ো, 'সাজাহান' নাটকে সাজাহান চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় যেমন দর্শকের আপ্লুত করেছে; তেমনি 'মিশর কুমারী', 'বৈকুণ্ঠের উইল', 'শ্যামলী', 'বিদ্যাসাগর', 'মন্ত্রশক্তি' প্রভৃতি প্রায় নব্বইটি ছবিতে বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে সার্থক রূপদান করে আজও দর্শক মনে তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

অহীন্দ্র শুধু অভিনেতা ছিলেন না, তিনি দুটি ছায়াছবি পরিচালনাও করেছিলেন। সব চেয়ে বড় কথা, বাংলা সিনেমা ও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যখন হামাগুড়ি দিতে শিখছে, তখন তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে হাল ধরে তাকে লালন-পালন করেছেন দীর্ঘকাল ধরে। বাংলা চলচ্চিত্র আজ যে রূপে বিশ্বের দরবারে নিজস্ব স্বরূপ নিয়ে এতকাল উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে, তার সলতে পাকানোতে তাঁরও অবদান  রয়েছে।  বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর অবদান আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...