চাষের মাঠ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসঘর। মাঝে আর কিচ্ছু নেই, শুধু স্বপ্ন আর সাহস ছাড়া। সেই দুই অস্ত্রকে সম্বল করেই আজ রসায়নে পিএইচডি সম্পূর্ণ করেছেন সাকে ভারতী। পেশায় ক্ষেতমজুর। অন্ধপ্রদেশের অনন্তপুর জেলার অখ্যাত এক গ্রামে তাঁর বাস। কিন্তু পড়াশোনার তীব্র ইচ্ছে আর অদম্য জেদে অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি আজ গোটা দেশের নজরে।
অত্যন্ত দরিদ্র সহায় সম্বলহীন পরিবারের মেয়ে। আরও তিন ভাইবোন আছে তাঁর। ভাত জোগাতেই এত লড়াই করতে হত যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া তাঁদের সংসারে ছিল বিলাসিতার সামিল। ছোট থেকেই এসেছে একের পর এক চ্যালেঞ্জ। নতুন বই, নতুন স্কুল ড্রেস তো অনেক দূরের ব্যাপার। সে সব মিলুক না মিলুক ছোটবেলা থেকে ভারতী জানতেন যে কোনওভাবে পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতেই হবে তাঁকে। পরিস্থিতির কাছে হার মানলে চলবে না। সরকারী বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি এভাবে চলে।
নিম্নবিত্ত পরিবারটিতে আর্থিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয় যে রাতারাতি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় ভারতীর। স্কুল শেষ হতে নাহতেই মা হয়। দরিদ্র পরিবার, বিবাহিত জীবন, অকাল মাতৃত্ব সব দিক মিলিয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নিজের স্বপ্নকে কখনও হারাতে দেননি তিনি। বরং তা যাতে হারিয়ে না যাই তাই বেছে নিয়েছিলেন আরও শক্ত লড়াইয়ের রাস্তা।
সংসারের দায়িত্ব আর নিজের পড়ার খরচ নিজে চালানোর জন্য ক্ষেতমজুরের কাজ নিলেন। সংসার, সন্তান, শিক্ষা-এই তিন দিক বজায় রাখতে এটাই ছিল তাঁর কাছে অপেক্ষাকৃত সহজ পথ। একমাত্র পড়াশোনা বদলে দিতে পারে তাঁর জীবন- এই বিশ্বাসেই দিনরাত এক করে পরিশ্রম করতেন বিজ্ঞানের ছাত্রীটি।
সূর্যোদয়ের আগে দিন শুরু হয় তাঁর। বাড়ির কাজ সামলে মাঠে যেতে হয়। সেখান থেকে ফিরে রওনা হতেন কলেজের উদ্দ্যেশ্যে। বেশ কয়েক মাইল দূরে বাস স্টপ। এই রাস্তাটা হেঁটেই পার হতেন। কলেজের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। রোদ-জল-ঝড়-বৃষ্টিতে কোনওদিন ফাঁক পড়েনি এই রুটিনে।
এভাবেই অনন্তপুরের এসএসবিএন ডিগ্রি অ্যান্ড পি.জি কলেজ থেকে রসায়নে এমএসসি পাস করেন ভারতী। অধ্যাপকরা এই মেধাবী ছাত্রীটিকে সাহস দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ দেবরায়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে নিজের নাম নথিভুক্ত করার জন্য। বাইনারি লিক্যুইড মিক্সচার এই বিষয়ে গবেষণা করে পেয়েছেন ডক্টরেট সম্মান। স্কলারশিপও পেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন ভারতী।
ভারতীর চান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে। তিনি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন শিক্ষা কীভাবে বদলে দিতে পারে জীবন। সমাজ বদলে দিতে পারে একমাত্র শিক্ষাই। পেটে ভাত নেই, কান্না আসছে, খিদেয় কাঁপছে শরীর তবু কখনও নিজের স্বপ্নটাকে ভুলতে নেই। ভারতী যখন এই কথা বলেন তখন মনে হয় না তা শুধু মাত্র কথার কথা, নিজের জীবন দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে জেদ থাকলে জীবন বদলাবেই। নাহলে যে হাত সকাল হলে ঘুঁটে দেয় কাস্তে ধরে, ধান ঝাড়ে, বীজ রোঁয়ার কাজ করে দুপুরে সেই হাতই ল্যাবরেটারিতে কেমিস্ট্রির নোট নিতে ব্যস্ত থাকে কীভাবে!
ভারতী কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁর স্বামী শিবপ্রসাদকে। আজকের সাফল্যের নেপথ্যে এই মানুষটি। শিবপ্রসাদ পাশে না দাঁড়ালে ভারতীর জীবন হয়ত আঁধারেই হারিয়ে যেত। সদ্য স্কুল পাশ মেধাবী ছাত্রীটির পড়াশোনার প্রতি ভালবাসা আর খিদেকে তিনি বুঝেছিলেন। তাই স্ত্রীর স্বপ্নপূরণের পথে কখনও বাধা দেননি তিনি। পাশে থেকেছেন। দিয়েছেন মনের জোর। শিবপ্রসাদ নিজে ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক। পরের জমিতে ক্ষেতমজুরি করে দিনপাত হয়। কিন্তু স্ত্রীর সাফল্যে প্রচন্ড গর্বিত। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, ‘সবসময় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখত আমার স্ত্রী, শেষ পর্যন্ত সে সফল হয়েছে’…
ভারতীর স্বপ্ন আসলে শিবপ্রসাদেরও স্বপ্ন যে।