আজ পয়লা অঘ্রাণ, মরা কার্তিক পার করে অগ্রহায়ণ এসে দাঁড়ায় বাংলার নিকোনো উঠোনে। আশ্বিন সংক্রান্তিতে যে ধানকে সাধ খাইয়েছিলেন কৃষক, এবার তার ফলনের সময়। মাঠ থেকে ধান উঠবে। এ যে লক্ষ্মীর মাস। খেতের ফসলই তো লক্ষ্মী। এ মাসেই ধান গোলায় তোলে কৃষক। আমন ধান ওঠার পর সেই নতুন ধান দিয়ে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। চণ্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী বলেছিলেন- 'ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জনম তার, নাই যার চাষ।' নদীমাতৃক কৃষিজীবী বাংলার একদা বছরের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। এই মাসের আরেক নাম মার্গশীর্ষ। 'অগ্র' শব্দের অর্থ 'আগে' আর 'হায়ণ' শব্দের অর্থ 'বছর'। বছরের প্রথম বা শুরুর মাস বলেই নাম 'অগ্রহায়ণ'।
কার্তিক সংক্রান্তি থেকে অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি অবধি, গোটা মাস জুড়ে ইতুর পুজো দেন বাংলার মায়ের। ঘরের কোণে ইতুর ঘট পাতা হয়। ইতু একেবারে বাঙালির নিজস্ব পার্বণ। ইতু আদপে সূর্যের আরাধনা। বাংলার মেয়েরা ইতুকে শস্যের দেবী হিসেবেই পুজো করে। ইতুর ঘটের গায়ে পুতুলি আঁকা ও ভেতরে দেওয়া হয় শস্যদানা ও তৃণগুচ্ছ। খড়ের বিঁড়ের উপরেই ইতুর সরাকে বসানো হয়। এরপর সরাতে মাটি দেওয়া হয়। মাটি পূর্ণ সরার মাঝে ঘট স্থাপন করা হয়। কলমী, সর্ষে, শুষনীর মূলসহ শাক, মানকচুর মূল রোপণ করা হয়। ছোলা, মটর, মুগ, তিল, যব-সহ আট রকমের শস্যের বীজও ছড়ানো হয়। ইতুকে সাধভক্ষণের প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও। নতুন গুড় ও চাল দুধ দিয়ে পায়েস রেঁধে নিবেদন করা হয়। গোটা মাস জুড়ে ফি রবিবার ফল, মিষ্টি, ধান, খই দিয়েই ইতুর পুজো করা হয়। ঘট স্নান করিয়ে, দুর্বা, ফুল ও চন্দনে সাজিয়ে, নতুন আতপ চালে তৈরি আসকে পিঠে নিবেদন করে ইতুর আখ্যান শোনান মায়েরা। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে কোনও জলাশয় বা নদীতে ইতু ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। ইতু বিসর্জনের সময় ইতুর সরা অর্থাৎ ঘট শুশনি, কলমি, কচু, ছোলা, মটর, মুগ, কলাই ও যবের গাছ ও শস্যদানা দিয়ে সাজানো হয়।
হেমন্তলক্ষ্মীর পুজো হয়। অগ্রহায়ণের মূল উৎসব কিন্তু নবান্ন। নবান্ন শব্দের অর্থ 'নতুন অন্ন'। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসব। নবান্নে নতুন গুড়, নতুন অন্ন অর্থাৎ নতুন চালের তৈরি খাবার বানিয়ে প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের নিবেদন করা হয়। কাককে দেওয়া হয় নবান্নের অগ্রভাগ। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাবার পূর্ব-পুরুষদের কাছে পৌঁছয়। এই নৈবেদ্যকে বলে 'কাকবলী'।
কলার ডোগায় নতুন চাল, কলা, নারকেল নাড়ু কাককে খাওয়াতে হয়। ছোট ছেলে-মেয়েরা ছড়া কেটে দাড় কাককে নিমন্ত্রণ করে,
"কো কো কো,
আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন।
শুভ নবান্ন খাবা, কাকবলি লবা,
পাতি কাউয়া লাঠি খায়,
দাড় কাউয়া কলা খায়,
কো কো কো,
মোর গো বাড়ি শুভ নবান্ন।"
লক্ষ্মীর পুজো, পিতৃশ্রাদ্ধ, বীরবাশ। গোবর নিকোনো উঠোনে মধ্যিখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী গোলা দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে ধানের ছড়া বাঁধা হয়। এটাকে বীরবাশ বলে। সব লোকাচার মিটিয়ে তারপর গৃহী তাঁর কুটুম নিয়ে নবান্নে খেতে বসেন। নবান্নের পর দিনও নবান্নের রেশ থাকে সেটাকে বলা হয় বাসি নবান্ন বা বাস নবান্ন। জীবনানন্দ, কার্তিকের কাক হয়ে উত্তরপুরুষদের খাদ্যের অগ্রভাগই হয়তো খেতে আসতে চেয়েছিলেন।
মাঠের ফসল উঠলে ঘরে লক্ষ্মী আসেন। কৃষিভিত্তিক দেশ বাংলা, ফসল ফলিয়ে দিনগুজরান হত বাঙালির। অর্থাৎ ফসলে বসতে লক্ষ্মী। আজ দিন বদলেছে। ফসল ফলানো লোকের সংখ্যা কমেছে। বাংলার শিকড় আজও সজীব অগ্রহায়ণের রীতি-রেওয়াজের মধ্যে দিয়ে।