সেই লড়াই ছিলনা মাতৃভাষার। সেই লড়াই ছিল সাম্যের।দক্ষিন আফ্রিকার সোয়েটো। সোনার খনির শ্রমিকদের বসতি৷এককথায় অচ্ছুত আবাস।সে দেশে সব শহরের বাইরেই এরকম অচ্ছুৎপল্লি আছে। কালো শ্রমিকদের জন্য।
টাউনশিপ, মানে কুলি বস্তি। ১৯৭৫ সালে চলেছিল গুলি বর্ষণ। হয়েছিল নিরীহ ছাত্রদের রক্তপাত। সরকার থেকে একটি শিক্ষানীতি হয়েছিল । শুধু সাদা চামড়ার লোকই ইংরেজিতে শিক্ষা পাবে। কালোদের পড়ানো হবে আফ্রিকান ভাষাতে ৷প্রতিবাদে নামলো সাধারণ পড়ুয়া।শ’য়ে শ’য়ে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে চলছিল মৌন মিছিল। ‘অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চাই’, ‘আমরাও ইংরেজি পড়তে চাই’ ইত্যাদি৷ সেই মিছিল পরিণত হয়েছিল লাশের স্তূপে।সেই লাশের ডিঙিয়েই সেই মহাদেশের আগামীর স্বাধীনতা যাত্রা।
১৯৭৪ সালে সরকারের তরফে রাখা সেই বর্ণ বিদ্বেষী মুচলেকা। শোনামাত্রই ঝড় তোলে সবুজ কিশলয়েরা।ইংরাজী শিক্ষা না পাওয়া মানেই উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া।মেধাবী যারা, তারাও পারবেন দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে। কালো চামড়া নিয়ে জন্মানোর সাজা।১৯৭৬ এর ১৬ই জুন।আফ্রিকার ক্যালেন্ডারে অভিশপ্ত দিন। পথে নামলো পড়ুয়ারা।মিছিল শান্ত ভাবেই এগচ্ছিল। পুলিশ এসে থামতে বলে৷ তাও পা থামালনা ওরা।সকলের নিঃশব্দে চাহনি জানতে চাইছে এই বিভাজনের কারণ। নিঃশব্দে৷ আবার ভেসে এল, ‘থামো’৷পৃথিবীর সকল শক্তি তখন ছাত্রদের বুকে, মুখে।ওরা এগিয়ে চলল৷ ধেয়ে এল গুলি৷বিপ্লবের মৃত্যু বারুদে। প্রথমেই লুটিয়ে পড়ল হেক্টর পিটারসন।বছর ১১ কিশোর৷ অপরাধ? তারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ চেয়েছিল৷ পিটারসেন এর বুক চিড়ে সেই বুলেট ঝড়ের গতিতে ধেয়ে গেল অন্যদের বুকে। হাওয়ায় তখন রক্তের আবির।
সেদিনের আন্দোলন দানা বাঁধেনি। তবুও সেই শক্তি কাঁধে নিয়েই এগিয়ে এসেছিল আরও শত শত। ভাষার অধিকারের আন্দোলন হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার আন্দোলন।আরও প্রায় ২০ বছর। ১৯৯৪ পর্যন্ত চলেছিল সেই রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ। প্রতীক হয়ে উঠেছিল তেরো বছরের হেক্টর।রূপ পাল্টেছে। যতদিন না অ্যাপারথেইড ব্যবস্থা সম্পূর্ণ মুছে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে।নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার৷ অসম শিক্ষাপ্রণালীর বিরুদ্ধে আন্দোলন নেমেছিলেন নানা অঞ্চলের শ্রমিক পল্লির কালো মানুষ, নারী–পুরুষ–শিশু–কিশোর । ভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন অন্ততপক্ষে ৫৭৫ জন৷ মতান্তরে ৭০০ এবং ১৭৬ জন।
একাধিক ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশে বিভক্ত আফ্রিকা, বিভিন্ন ভূখণ্ড বারে বারে স্বাধীনতা, বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে৷ অধিকার লড়াইয়ের সেই সব দশকে কেঁপে গিয়েছে দুনিয়া৷ ‘মানহারা মানবী’-এর পাশে দাঁড়িয়েছে একের পর এক দেশ৷ তীব্র আন্তর্জাতিক টানাপোড়েনের মাঝেই কেটেছে সেই রক্তাক্ত মুহূর্ত৷বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার আন্দোলনেও বলি গিয়েছে অনেক প্রাণ। তাঁদের ত্যাগের উপহারই আজকের ভাষা দিবস। ভাষার সম্মান ও স্বীকৃতি।তবে সেই সংখ্যাটা আফ্রিকার ওই স্কুল পড়ুয়াদের তুলনায় আসেনা বললেই চলে। মাতৃভাষা নয়, তারা লড়েছিল অধিকারের লড়াই।ইতিহাস তোলপাড় করেছে তারাও। ঢেউ তুলেছে সাম্যের।আসন্ন ভাষা দিবস উদযাপনে আফ্রিকার সেই শহীদ কিশোরদেরও এবার স্মরণ করার পালা।২১ শে ফেব্রুয়ারি হোক আর ১৬ই জুন। ভাষার অধিকারে আন্দোলন এভাবেই চলেছে ও চলবে।