ভারতেও রয়েছে এক টুকরো আফ্রিকা

ভারতের মধ্যেও আছে এক টুকরো আফ্রিকা, যার পরতে পরতে রয়েছে আফ্রিকান সংকৃতির ছাপ। ভারতের এই বিশেষ অংশটির কথা হয়তো অনেকে ভারতবাসীর কাছেই অজানা। তবে এই হিন্দিভাষী আফ্রিকান মানুষগুলি কিন্তু মনেপ্রাণে ভারতীয়। তারা ভারতকে নিজের মাতৃভূমি ভেবেই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। শতাধিক বর্ষ ধরে এই সম্প্রদায় ভারতে বসবাস করছে। কথিত আছে সপ্তদশ শতকের শেষে তাদেরকে ভৃত্য হিসাবে আনা হয়েছিল ভারতে, কে এনেছিল এই নিয়ে রয়েছে দ্বিমত। অনেকে বলেন পর্তুগিজরা প্রথম তাদের সাথে এই আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের ভারতে নিয়ে আসে আবার কেউ বলেন যে তারও আগে আরব থেকে এদের নিয়ে আসা হয়েছিল এই দেশের মাটিতে। দাসপ্রথার অবসান ঘটলে এরা জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। প্রায় অজ্ঞাতবাসের মতো করেই তারা জীবনধারণ করতে থাকে যাতে না আবার তাদের অন্য কারোর দাস হয়ে থাকতে হয় ও অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করতে হয়। ইতিহাসের পাতায় মলিন হয়েছে এই কাহিনী। পরবর্তীকালে ভারত সরকারের উদ্যোগেই এই সম্প্রদায় পায় তাদের বাসভূমি ও সম্মান। সম্প্রদায়টি সিদ্দি বা হাবশী সম্প্রদায় নামে পরিচিত।

(জুজে জ্যাকি হারনোডকার সিদ্দি)

      একমাত্র ও বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায় হিসাবে সিদ্দি গুজরাট, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং অন্ধ্র প্রদেশের উপকূলে বিস্তৃত। তবে তাদের প্রধান জনসংখ্যা জুনাগড় জেলায় কেন্দ্রীভূত। ৫০,০০০-৬০,০০০ জন আনুমানিক জনসংখ্যার সিদ্দি সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই মুসলিম ধর্মাবলম্বী, যদিও কর্ণাটকের লোকেরা ক্যাথলিক। পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার পুরোনো নাম ছিল আবিসিনিয়া যাকে আরবিরা আল-হাবাস নাম ডাকত। আর সেখান থেকেই আবিসিনিয়ার অধিবাসীর নাম হাবশী হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব আফ্রিকায় সিদাওয়া নামে এক সম্প্রদায় ছিল যার একটা উপজাতি ছিল সিদ্দি। ভারতে এদের ভৃত্য ছাড়াও সেনাদলে যোগ করা হত। তবে ক্রমশ তাদের নিজের ক্ষমতায় তারা শাসকের স্থানও দখল করে। মালিক অম্বর যিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন সিদ্দি আহমেদনগরের নবাব হিসাবে পরিচিত হন পরবর্তীকালে। তিনি নিজে একাই সিদ্দি সম্প্রদায়ের এক সৈন্য দল তৈরী করেন যা মুঘল সেনাদলের ভীতকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। লেখক আবাবু মিন্ডা য়েমিনি রচিত 'এন আফ্রিকান ইন্ডিয়ান কমিউনিটি ইন হায়দ্রাবাদ' অনুসারে মালিক অম্বর অনেক ছোট ছিলেন যখন তাকে আরবি সওদাগর ভারতে আনে। ভারতে ভৃত্য হিসাবে বহুবার চলেছে তার কেনাবেচা। পরে যখন তিনি আহমেদনগর পৌঁছান তখন তিনি তিন হাজার সেনার দল তৈরী করেন। মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার প্রায় ৩৫০ বছরের পুরোনো কেল্লাটি তার পরাক্রমের নিদর্শন। বাংলার রাজত্বের ইতিহাসে পাওয়া যায় এরকমই একটি নাম- সামসুলদিন ইলিয়াস শাহ, যিনি ছিলেন একজন সিদ্দি।

   (কমলা বাবু সিদ্দি) 

   আশির দশক থেকে জঙ্গলে বসবাসকারী সিদ্দির খোঁজ করা শুরু হয়, কারণ ছিল ১৯৮৪ অলিম্পিক গেম্স। ১৯০০ সাল পর্যন্ত ভারত কখনোই অলিম্পিকে মেডেল জিততে পারে নি। আফ্রিকান এই ভারতীয়রা অলিম্পিকে ভালো পারফর্ম করতে পারবে এই জন্য শুরু করা হয় কড়া অনুশীলন। তখনকার ক্রীড়ামন্ত্রী নেন এই সিদ্ধান্ত। ১৯৮৫তে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-র উদ্যোগে তাদের জন্য স্পেশাল এরিয়া গেমস চালু হয় এবং বিশেষ ট্রেনিং শুরু করা হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকা আফ্রিকান অরিজিন এর ভারতীয়রা একত্রিত হয় স্পোর্টসের মাধ্যমে। স্টেট, ডিস্ট্রিক্ট, ন্যাশনাল লেভেলে তারা জিততে থাকে একাধিক পুরস্কার। আফ্রিকান রীতি, নীতি, সংস্কৃতি এসবের প্রতিফলন খুব সুন্দরভাবেই দেখা যায় তাদের বসত গ্রামগুলিতে। এই সম্প্রদায়ের মহিলারাও সমানভাবে অংশগ্রহণ করে সব কাজে। এখনো এদের জীবিকা নির্বাহের একটা প্রধান অঙ্গ হল এদের বিশেষ নাচ যা দেখিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে তারা অর্থ উপার্জন করে থাকে। অনেকে আবার মেট্রোপলিটন শহরে এসে চাকরিও করে তার সংখ্যা যদিও খুব সামান্য। ভারতের আফ্রিকান অধিবাসীরা কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার দরুন এখনো অনেকেই তাদের হেয় করে কিন্তু এই সিদ্দি সম্প্রদায়ের ঝুলিতে রয়েছে জুজে জ্যাকি হারনোডকার সিদ্দি, কমলা বাবু সিদ্দি, ফিলিপ এন্টোনি সিদ্দি ইত্যাদির মতো বহু নাম যাঁরা ইন্ডিয়ান স্পোর্টস হিস্ট্রিতে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।

    অনেকগুলি ফুলের পাঁপড়ি নিয়ে যেমন একটা ফুল হয়, তেমনি ভারতের এই "মিনি আফ্রিকা" ভারতেরই একটা অংশ। সর্বজাতি-সর্বধর্ম-সমন্বয়ে বিশ্বাসী ভারতবাসীর গর্ব তারা। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...