কমিক স্ট্রিপের জনপ্রিয় চরিত্র: অরণ্যদেব

পরনে বেগুনি রংয়ের আঁটোসাঁটো পোশাক। সঙ্গে মাস্ক। ভয়হীন। এক অতিমানব বলা যেতে পারে। জঙ্গলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সে ছুটে বেড়ায়। অন্যায়, দুর্নীতি, লোলুপতা দেখলেই লড়াই করে। শুভশক্তির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। নাম তার 'অরণ্যদেব'। আমাদের শৈশবের 'সুপারহিরো'।

এই চরিত্রের নির্মাতা লি ফক। আফ্রিকার এক কাল্পনিক দেশ বাঙ্গালা। সেই দেশের এক তরুণ নাবিক ক্রিস্টোফার ওয়াকার। ১৫১৬ সালে জন্ম পোর্টসমাউথ শহরে। ক্রিস্টোফারের বাবাও ছিলেন নাবিক। বাবার পথ অনুসরণ করে ছেলেও নাবিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

Phantom1

১৫৩৬ সালে ক্রিস্টোফারের বাবা সমুদ্রের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সঙ্গী ছেলে। জলদস্যুরা হঠাৎই আক্রমণ করে ক্রিস্টোফার-এর জাহাজ। মারা যায় বাবা অর্থাৎ ক্রিস্টোফার সিনিয়র। জাহাজে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি ক্রিস্টোফার জুনিয়র সংজ্ঞা হারিয়ে বাঙ্গালার সমুদ্র সৈকতে ভেসে ওঠে। সেখানে বান্দার গোত্রের পিগমিরা তাকে সুস্থ করে তোলে। মৃত বাবার খুলি হাতে নিয়ে সে শপথ গ্রহণ করে অন্যায় শেষ করার। পিগমিরা তাকে জঙ্গলের মধ্যে মানুষের খুলির আকৃতির এক গুহার সন্ধান দেয়, সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে ক্রিস্টোফার জুনিয়র। এক দেবতার উপর ভিত্তি করে তৈরি পোশাক পরে সে হয়ে ওঠে জঙ্গলের রক্ষক। এভাবেই জন্ম হয় শৈশবের ফ্যান্টাসি 'ফ্যান্টম'-এর।

ক্রিস্টোফার জুনিয়র-এর মৃত্যুর পর তার ছেলে হয়ে ওঠে ‘ফ্যান্টম’। এইভাবে বংশানুক্রমে 'ফ্যান্টম' ধারা চলতে থাকে।

'ফ্যান্টম' চরিত্রের উৎপত্তি আমেরিকাতে হলেও সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই অতি-মানবীয় চরিত্র। ভারতে ফ্যান্টমই অরণ্যদেব। এভাবেই একুশটি বংশ ধরে ফ্যান্টমরা রক্ষা করে চলেছে জঙ্গলকে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে রয়েছে ফ্যান্টম বা অরণ্যদেব।

Phantom2

একবিংশতম ফ্যান্টমের নাম কিট ওয়াকার। বাঙ্গালার জঙ্গলেই শৈশব কেটেছে কিটের। বারো বছর বয়সে সে পড়াশোনা করতে যায় মিসৌরির ক্লার্কসভিল শহরে। এখানে আলাপ হয় প্রেমিকার ডায়ানা পামারের সঙ্গে। একবিংশতম অরণ্যদেব দক্ষ খেলোয়াড়, শিক্ষার্থী। কিন্তু সে ভোলেনি তার পারিবারিক ঐতিহ্য। তাই সে বাঙ্গালার জঙ্গলেই ফিরে যায় পড়াশোনা শেষ করে। হয়ে ওঠে সেখানকার রক্ষক। নিজের বাবার খুনি রাম সিং নামের জলদস্যুকে পরাস্ত করে সে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়। কিটের দুই সঙ্গী বাঘা নামের নেকড়ে আর বিদ্যুৎ নামের ঘোড়া। আরো পোষ্য রয়েছে তার। দুই যমজ সন্তান রয়েছে কিটের।

আমাদের শৈশব রঙিন হয়েছে সুপারহিরোদের কাল্পনিক উপস্থিতিতে। ফ্যান্টম বা অরণ্যদেব তেমনি একজন। কোন অলৌকিক শক্তি নেই অরণ্যদেবের। বুদ্ধিমত্তা, মানসিক শক্তি এবং মার্শাল আর্ট ট্রেনিং-এর সাহায্যে সে পরাস্ত করে শত্রুদের।

Phantom3

ফ্যান্টমের আরো অনেক নাম রয়েছে। 'দ্য ঘোস্ট হু ওয়াকস'। 'দ্য ম্যান হু নেভার ডায়িস'। 'গার্ডিয়ান অফ দ্য ইস্ট ডার্ক'।

জঙ্গল-মানব রহস্যময় অরণ্যদেবের আবির্ভাব ১৯৩৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি 'কিং ফিচারস সিন্ডিকেট' পত্রিকায়। তখনো রঙিন হয়নি এই কমিক চরিত্র। শৈশবের রঙিন কল্পনার তখনো সাদা-কালো। প্রথমবার বেগুনি রঙের পোশাকে আবির্ভাব ঘটে ১৯৩৯ সালে।

ফ্যান্টমের গল্পগুলোর রচয়িতা লি ফক। যিনি আরো অন্য কমিক চরিত্রেরও রচয়িতা। ফ্যান্টম এঁকেছেন রে মুর। প্রথম ফ্যান্টম লেখার পরে লি ফক ভেবেছিলেন কয়েকটি গল্পের পরই এই সিরিজের ইতি টানবেন।

কিন্তু ছবিটা পাল্টে দিলো ফ্যান্টমের জনপ্রিয়তা। নানা ভাষায় বিশ্বের অনেক দেশেই অনূদিত হতে শুরু করল ফ্যান্টম। ভারতে এল অরণ্যদেব নামে। তারপর অরণ্যদেব আমাদের শৈশবের সত্যি-মিথ্যে, ন্যায়-অন্যায় বোধের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে।

Phantom4

১৯৯৯ সালে মারা যান অরণ্যদেবের স্রষ্টা। তাঁর শেষ দুটি গল্প 'টেরর অ্যাট দি অপেরা' এবং 'দ্য কিডন্যাপারস' শেষ করেন লি ফকের স্ত্রী। বর্তমানে ফ্যান্টম সিরিজ লেখেন টনি ডি পল।

প্রত্যেক ফ্যান্টমের মৃত্যুর সময় তাঁর ছেলেরা লোভ, নিষ্ঠুরতা, অন্যায় দূর করার শপথ নেন। জঙ্গলকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। ত্রয়োদশতম ফ্যান্টম বাদে বাকি সকলেই পুরুষ।

আমাদের শৈশবকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে এইসব কমিক চরিত্র। কোথাও গিয়ে স্মৃতি হয়ে গিয়েছে এঁরা। তবে এসব চরিত্রদের গন্ডি সর্বদাই বয়সের ঊর্ধ্বে। কল্পনা আর বোধ গড়ে দেওয়ার কারিগর অরণ্যদেব এবং তার মত কমিক চরিত্ররা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...