সুপারহিরো-সাংবাদিক টিনটিন

স্মৃতির কোনো বয়স হয় না। কিছু স্মৃতি আজীবন একই সুরে ভেসে আসে। হয়তো সময়ের ভারে তারা আরো উজ্জ্বল হয়। মলিনতা তাদের স্পর্শ করে না। এমনই স্মৃতি বোধহয় ছোটবেলার কমিক সুপারহিরোরা। এঁরা শৈশবের এক অত্যাশ্চর্য জগত। সেই জগতে নেই কোনো জটিলতা। শুধু সারল্যে ভরা ম্যাজিক।

 

tin 1

 

বয়স বাড়লেও কম হয় না এদের আকর্ষণ। শৈশবের রঙিন দিনের এমনই এক নায়ক টিনটিন। হাজার মনখারাপেও হাসি ফোটানোর ক্ষমতা রাখে সোনালী ঢেউ-খেলানো চুলের এই মিষ্টি সাংবাদিক। তবে এইসব কমিক সুপারহিরোরা বেশির ভাগই বাস্তবের কোন চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। কখনো স্রষ্টার কল্পনার এক টুকরো নিদর্শন। তা এই টিনটিনের জন্ম কীভাবে? বইয়ের পাতায় আসার আগে স্রষ্টার ইচ্ছে হয়ে কেমন করে ছিল এই কমিক চরিত্র?

 

টিনটিনের স্রষ্টা বেলজিয়ামের কার্টুনিস্ট হার্জ। তাঁর আসল নাম জর্জেস রেমি। তবে আমাদের কাছে বেশি পরিচিত হার্জ নামেই। একটা সংবাদপত্রের অফিসে কাজ করতেন হার্জ। তিনি সাংবাদিক ছিলেন না। কাগজের পাতায় আঁকিবুকি কেটে কল্পনাকে তুলে ধরাই ছিল তাঁর পেশা। হার্জ যে পত্রিকায় চাকরি করতেন, তাঁর প্রধান সম্পাদক হার্জকে একবার বলেন সংবাদপত্রের জন্য একটি বিশেষ ছবি আঁকতে। সংবাদপত্রকে ঘিরেই যখন ছবি, তখন সৃজনশীল মানুষটি আঁকলেন এক সাংবাদিকের চিত্র। এই সাংবাদিক ভয়হীন, নিরপেক্ষ, দুর্নীতিহীন। সে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। দুঃসাহসী কাজেই তার মন।

 

সেই সাংবাদিক চিন্তা করতে পারে সাধারণের গন্ডির বাইরে। এই সাংবাদিকই আমাদের প্রিয় কমিক চরিত্র টিনটিন। এভাবেই জন্ম হল টিনটিন চরিত্রের। এর পরেরটা বোধহয়য় সকলেরই জানা। শৈশব আর টিনটিন সমার্থক হয়েছে। সৃষ্টির পর থেকে বোধহয় একটুও বাড়েনি টিনটিনের বয়স। তার সঙ্গে সে বাড়তে দেয়নি তার পাঠকদের বয়স।

 

টিনটিনের কমিক্স-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তার পোষ্য। স্নোয়ি। বাংলায় তার নাম কুট্টুস। লম্বা মত মুখ। গা ভর্তি সাদা লোম। সে সর্বক্ষণ ছুটে বেড়ায় তার মালিকের সঙ্গে। বুদ্ধি আর সাহসে স্নোয়ি টিনটিনের চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না।

 

এই কমিক্সের পার্শ্বচরিত্রগুলোও নায়কের মতই আকর্ষণীয়। যেমন একগাল দাড়িওলা নাবিক ক্যাপটেন হ্যাডক। প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করে এই নাবিক। অল্পেতেই ভীষণ রেগে যায়, অদ্ভুত সব শব্দ ব্যাবহার করে গাল পাড়ে রঙিন এই চরিত্র। এছাড়াও রয়েছেন এক বধির বৃদ্ধ বিজ্ঞানী প্রফেসর ক্যালকুলাস। এখানেই বোধহয় টিনটিনের গল্পগুলো অন্যান্য অনেক কমিক অ্যাডভেঞ্চারের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের চরিত্রের সমারোহ টিনটিনের কমিক্সগুলো জুড়ে।

  

tin 2

 

এমনকি গোয়েন্দাও মেলে টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীতে। যমজ ডিটেকটিভ 'জনসন অ্যান্ড জনসন'।

টিনটিনকে নিয়ে মোট চব্বিশটি গল্প লিখেছেন এবং এঁকেছেন হার্জ। প্রায় সত্তরটিরও বেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে টিনটিনের গল্প। প্রায় কুড়ি কোটিরও বেশি টিনটিনের চরিত্র সম্বলিত কমিক বই বিক্রি হয়েছে। রেডিও, টেলিভিশন, নাটক এমনকি থিয়েটারেও অভিনীত হয়েছে টিনটিনের গল্প।

 

টিনটিনের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার ''টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অফ সোভিয়েট''। ১৯২৯ সালে প্রথমবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল টিনটিনের গল্প। স্রষ্টা হার্জ নিজেও ভাবেননি তাঁর আঁকা সাংবাদিক সারা পৃথিবীবাসীর মন এভাবে জয় করে নিতে পারবে।

 

টিনটিন এবং তার পার্শ্বচরিত্রগুলো আঁকার ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করতেন হার্জ। 'ক্লিয়ার লাইন'। রেখা জুড়ে আঁকা।

 

টিনটিন বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। এই অ্যাডভেঞ্চার কমিক্স যথেষ্ট জনপ্রিয় বাংলাতেও। একটি সাক্ষাৎকারে হার্জ জানিয়েছিলেন টিনটিনের মুখ আঁকার সময়, তাঁর মনে ভেসে ওঠে আরেকটা মুখ। হার্জের দাদার মুখ। ছোট থেকেই দাদার অনুরাগী ছিল হার্জ। তার প্রতিফলন ঘটেছিল স্রষ্টার সৃষ্টিতেও।

 

tin 3

 

ভালোবাসা, সহজাত শৈশব একই মুদ্রার দু'পিঠ। এইসব কমিক চরিত্ররা কোথাও আমাদের জীবনের একটা অংশকে কখনো হারাতে দেয় না। সৃষ্টির মাধ্যমেই বেঁচে থাকে চরিত্র এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা বাস্তবের মানুষ আর তার স্মৃতি।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...