দক্ষিণের গঙ্গা পবিত্র গোদাবরী বয়ে চলেছে অন্ধ্রপ্রদেশের বুক চিরে। তারই তীরে পাহাড় ও অরণ্যঘেরা এক জনপদ বৈদূর্যপট্টনম। সেখানে একদা ছিল এক তপোবন, অরুণাশ্রম। অরুণ মুনি আর তাঁর পত্নী জয়ন্থী দেবী সেই আশ্রমে বাস করতেন। ধর্মে-কর্মে যাগযজ্ঞে তাঁরা নিরন্তর নিরত থেকে বেশ সুখে-শান্তিতে কালাতিপাত করতেন। তারপর একদিন সেখানেই জয়ন্থী দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন এক পুত্রসন্তান।
অরুণ মুনির পুত্রলাভের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল আশপাশের নানান আশ্রমে। সেই সকল আশ্রমের মুনি-ঋষিরা এই শুভ সংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন অরুণ মুনির সন্নিধানে। যোগ দিলেন আনন্দ উৎসবে। সকলে মিলে নবজাতক সন্তানের শুভ লক্ষণাদি নির্ণয় করে নাম দিলেন, ‘নিয়মানন্দ আচার্য’। এটা আজ থেকে এগারো শ’ বছর আগের কথা। অর্থাৎ নিয়মানন্দের আবির্ভাব ঘটেছিল সেই কোন এগারো শতকে। তাঁর জন্মের সঠিক তারিখ জানা না-গেলেও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভক্তজন পরম্পরার সূত্র ধরে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিটিকেই তাঁর আবির্ভাব দিবস হিসেবে ধরেন এবং উদযাপন করেন।
নিয়মানন্দ আচার্য কীভাবে ‘নিম্বার্ক আচার্য’ হয়ে উঠলেন, কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন বৈষ্ণবদের আদি গুরু; তা নিয়ে সারা ভারতে নানান কিংবদন্তি প্রচলিত আছেঃ
বাল্যেই অরুণ মুনি পুত্রের উপনয়ন সংস্কার সম্পন্ন করে নিয়মানন্দকে গুরুগৃহে পাঠান বেদ, বেদাঙ্গ, সাংখ্য, দর্শন, ছন্দ, অলংকার প্রভৃতি শাস্ত্রের পাঠ নিতে। আজন্ম নিয়মানন্দ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তাই দশ বছর বয়সের পূর্বেই তিনি উক্ত শাস্ত্রসমূহে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করে পণ্ডিতসমাজে একেবারে তাক লাগিয়ে দিলেন। তখন কত দূর দূর থেকে কত পণ্ডিত আসতে শুরু করলেন এই মেধাবী তথা বিস্ময়-বালক বিদ্বানকে দর্শন করে ধন্য হতে।
কিংবদন্তি অনুসারে, গুরুগৃহে পাঠগ্রহণের সময় স্বয়ং নারদমুনি স্বর্গ থেকে তাঁকে পাঠ দিতে আসতেন। দেবর্ষি নারদের কাছ থেকেই তিনি নারায়ণে অচলা ভক্তি লাভ করেন। দেবর্ষি তাঁর কানে স্বয়ং শ্রীনারায়ণের শ্রীমুখ নিঃসৃত আঠেরো অক্ষরের ‘গোপাল মন্ত্র’ দান করেন। দেবর্ষির নির্দেশেই তিনি ভারতবর্ষে বৈষ্ণবধর্মের ধ্বজা ওড়ানোর সংকল্প গ্রহণ করেন এবং তা কার্যে পরিণত করেন। নারদের কাছ থেকে পাওয়া ‘গোপাল মন্ত্র‘ পরবর্তীকালে নিয়মানন্দ তাঁর উত্তরসূরি শ্রীনিবাস আচার্যকে দান করেন। তাঁরই সূত্র ধরে সেই মন্ত্রে অধিকার আসে বল্লভাচার্য ও শ্রীচৈতন্যদেবের মতো বৈষ্ণবধর্মের প্রাণপুরুষদের।
দক্ষিণ ভারতে জন্ম হলেও নিয়মানন্দের কর্মভূমি উত্তর ভারতের ব্রজভূমি। যাঁর কানে শ্রীকৃষ্ণের ধন্যগাথা একবার প্রবেশ করেছে, তিনি কী আর কানুজন্মস্থান বা কানুর কর্মস্থান দর্শন বিনে থাকতে পারেন! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বাঁশির সুরে যেমন শ্রীরাধাকে ঘর থেকে নিতুই ডেকে লীলাভূমিতে নিয়ে আসতেন, তেমন করেই যুগে যুগে প্রতিটি ভক্তজনকে তিনি ব্রজভূমির পানে আকর্ষণ করেন। ওদিকে নিয়মানন্দ তো তখন কানে-মনে-দেহে সবেতেই কৃষ্ণময় হয়ে উঠেছেন; কাজেই তিনি কেমন করে আর পিতার আশ্রমে আটকে পড়ে থাকবেন!
কাজেই একদিন একাকী আশ্রম ত্যাগ করলেন তিনি। বেরিয়ে পড়লেন ব্রজভূমির উদ্দেশ্যে। তিনি যখন ব্রজভূমিতে এলেন, তখন সেই ভূমিতে বৌদ্ধ ও জৈনদের প্রবল প্রতিপত্তি। সেই প্রতিপত্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে কৃষ্ণরাধার অপার লীলামাহাত্ম্যগাথা; বিস্মৃতির পলি পড়তে শুরু করেছে তাঁদের বিশেষ বিশেষ লীলাভূমিতে, হারিয়ে যেতে বসেছে বৈষ্ণবদের তীর্থস্থানগুলির স্থানিক ইতিহাস। এই অবস্থায় ক্ষীয়মাণ বিষ্ণুভক্তদের হাত ধরলেন এসে নিয়মানন্দ। শ্রীকৃষ্ণের লীলাধন্য বৃন্দাবন, নন্দগ্রাম, বর্ষণা, মথুরা, গোবর্ধন, নিমগ্রাম হয়ে উঠল তাঁর প্রধান কর্মভূমি। ‘শ্রীমদভাগবত’-কে পরমগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে দ্বৈত-অদ্বৈতবাদের পাঠ দিয়ে বৈষ্ণবজনকে একত্রিত করতে শুরু করলেন তিনি, প্রচার করতে শুরু করলেন বিস্মৃত অতীতগাথা; পুনরুদ্ধার করতে শুরু করলেন সমস্ত লুপ্ত বৈষ্ণব-তীর্থ। তারপর তাঁরই হাত ধরে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রবল প্রতিপত্তি প্রতিহত করে একদা পুনরায় সেখানে বৈষ্ণবদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পেল।
আমরা জানি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলানদী যমুনা। এই নদী নিয়মানন্দের কাছে গঙ্গা-গোদাবরীর চেয়েও পুণ্যসলিলা। তিনি তাই এই যমুনাতীরেরই ধ্রুবক্ষেত্রে কুটির বেঁধে বৈষ্ণবোচিত দীনভাবে বসবাস করতেন। একদিন তাঁর কাছে এক দণ্ডী সন্ন্যাসী এলেন শাস্ত্র আলোচনা করতে। সন্ন্যাসীটি প্রকৃতিই তত্ত্বসন্ধানী। কাজেই দু’জনেই ডুব দিলেন অতল অতুল ঈশ্বরতত্ত্বের আলোচনায়। কখন দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা এসে উপস্থিত হল, দু’জনেরই খেয়াল রইল না। যখন খেয়াল হল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ প্রায়। এই সময় দণ্ডী সন্ন্যাসী আপন আবাসে ফেরার জন্য বিদায় চাইলেন।
কিন্তু নিয়মানন্দ বিদায় দেবেন কী করে, তিনি তো বৈষ্ণব, অতিথি তাঁর কাছে যে নারায়ণ; সেই নারায়ণের যথাবিহিত সেবা না-করে বিদায় দিলে অধর্ম হবে যে! পাদ্য, অর্ঘ্য, আহার, শুশ্রূষা—এই-ই তো অতিথিসেবার অঙ্গ। ঈশ্বরের আলোচনায় এসবের খেয়ালই ছিল না যে তাঁর। কিন্তু নিয়মানন্দ জানেন, এখন আর এসবের অনুকূল সময় নেই। কেননা, দণ্ডী সন্ন্যাসীরা সূর্যাস্তের অতিথি সেবা গ্রহণ করেন না। এ-কথা মনে হতেই দারুণ অস্বস্তি শুরু হল নিয়মানন্দের মনে। অসম্ভব বিচলিত হলেন তিনি। অতিথি-নারায়ণ কিছু মুখে না-দিয়েই বিদায় নেবেন; এটা তাঁর বৈষ্ণব-মন কিছুতেই মেনে নিতে চাইল না। তিনি মনকে স্থির করে অতিথিকে খানিক অপেক্ষা করতে বলে নিজে বসলেন ইষ্ট শ্রীবিষ্ণুর স্তবে।
অবিলম্বেই পরম ভক্তের অন্তরের আকুতিময় স্তবে ঈশ্বর সাড়া দিলেন। ঘটালেন এক অসম্ভব অলৌকিক ঘটনা। আশ্রমের সম্মুখে একটি নিমগাছ ছিল, তারই মাথার ওপর উদিত হল নতুন সূর্য। দিগ্বিদিকে বিচ্ছুরিত হল নবারুণের ছটা। এই দিবাকালে দণ্ডী সন্ন্যাসীর আহার ও সেবা গ্রহণের আর বাধা রইল না। তিনি নিয়মানন্দের নিকট থেকে আহার ও সেবা গ্রহণ করে তুষ্ট হয়ে বিদায় নিলেন। বৈষ্ণবের সেবাধর্ম পালনের জন্য এই যে নিয়মানন্দ অসাধ্যসাধন করে অকালে সূর্যোদয় ঘটালেন, এই ঘটনার কথা ঋষি-মুনি-দেব-মানব সকলের কাছে অচিরেই প্রচারিত হল। অমনি সকলে একেবারে ‘ধন্য ধন্য’ করে উঠলেন। তখন সেই অলৌকিক বিরল ও মহান ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে সকল পণ্ডিতেরা নিয়মানন্দের নাম দিলেন, ‘নিম্বার্ক আচার্য’। তিনি নিম গাছের ওপর অর্ক বা সূর্যের উদয় ঘটিয়েছিলেন বলেই তাঁর এরকম নাম দেওয়া হল। এর পর থেকেই তিনি বৈষ্ণব-সমাজে তো বটেই, এমনকি সারা ভারতের পণ্ডিতজনের কাছেও ‘নিম্বার্ক আচার্য’ নামেই বিখ্যাত তথা স্মরণীয় হয়ে উঠলেন।
নিম্বার্ক আচার্য এই যে অলৌকিক ঘটনাটি ঘটালেন, এর পেছনে আমাদের একটি লৌকিক ব্যাখ্যা রয়েছে। দেখুন, পৌরাণিক বা কিংবদন্তি অনেক কাহিনিই অলৌকিক প্রতীকের আড়ালে অন্য একটি লৌকিক কথা বলে। আমাদের মনে হয়, এই গল্পের মধ্যে সে-রকমই একটি ইঙ্গিত আছে। আসলে, বৈষ্ণব ধর্ম অন্যান্য ধর্মের দাপটের আড়ালে ব্রজমণ্ডলে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া সূর্যের মতোই অস্তমিত হয়েছিল; নিম্বার্ক আচার্যই প্রথম এই সময় বৈষ্ণব ধর্মকে রাত্রির অন্ধকারের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য থেকে উদ্ধার করে যেভাবে পুনরায় প্রতিষ্ঠা দেন, তা অকালে সূর্যোদয় ঘটানোর মতোই মহান ও অসম্ভবের মাঝে সম্ভব একটি কর্ম। আসলে, আচার্যের প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারের সূত্র ধরেই বৃহৎ-বাংলা ও ওড়িশায় একদা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মতো জাগরণপুরুষের নেতৃত্বে বৈষ্ণবধর্মের জোয়ার এসেছিল। সেই জোয়ার সঙ্গীত, কারুশিল্প ও সাহিত্যে বঙ্গভূমি তো বটেই অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা-সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।
নিম্বার্ক আচার্যের ধর্মদর্শন হল, ‘দ্বৈত-অদ্বৈতবাদ’। এতে ব্রহ্মের সঙ্গে জগত-প্রপঞ্চকে কখনও অভিন্ন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্ন হিসেবে দেখা হয়। তাঁর মতের অনুসারী বৈষ্ণব ভক্তজন ‘নিম্বার্ক সম্প্রদায়’ নামে পরিচিত। এঁরা আবার দু’টি শাখায় বিভক্ত, ‘বিরক্ত’ অর্থাৎ ‘সংসারবিবাগী ভক্তজন’ ও ‘গৃহস্থ’ অর্থাৎ ‘সংসারীভক্তজন’। এঁরা নির্বিশেষে রাধা-কৃষ্ণের যুগলবিগ্রহ পূজা করেন। কপালে গোপীচন্দন তিলক আঁকেন। ব্রজভূমি পরিব্রাজন করেন। আর ‘শ্রীমদভাগবত’ অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। ভক্তেরা নিম্বার্ক আচার্যকে ভগবান বিষ্ণুর ‘সুদর্শন চক্র’-র মানব অবতার বলে মনে করেন। ব্রজভূমির নিমগ্রামে তাঁর একটি মন্দির রয়েছে। সেখানে আচার্যের বিগ্রহ নিত্য পূজিত হয়। এবং প্রতি বছর কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে তাঁর আবির্ভাব দিবস সাড়ম্বরে পালিত হয়।...