অ্যাডাম 'ফেয়ার-প্লে’ গিলক্রিস্ট

অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নাম শুনলেই মনে ভেসে ওঠে মারকুটে এক ব্যাটসম্যানের কথা, যিনি উইকেটের পেছনেও সমান ক্ষিপ্রতায়  ভয় পাইয়ে দিতেন প্রতিপক্ষকে। নিজের সময় তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা একাদশে জায়গা পাওয়ার অন্যতম দাবীদার তিনি।

 

রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বে ২০০৭ সালে হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড গড়ে অস্ট্রেলিয়া। এই বিশ্বকাপের ফাইনালে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ১৪৯ রানের ইনিংস বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরার মর্যাদা পেয়েছে। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়েই এমন অসংখ্য নান্দনিক ইনিংস খেলেছেন গিলি।

 

তরুণদের জায়গা করে দেয়ার জন্য ২০০৮ সালের ৪ মার্চ ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে খেলেন গিলক্রিস্ট। ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের অন্যতম বড় বিজ্ঞাপন ছিল। মাঠে কোনও ক্রিকেটার যখন ফেয়ার-প্লে’র দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তখন উদাহরণ হিসেবে সর্বাগ্রে উঠে আসে গিলির নাম।

 

Gilchrist1

 

১৯৭১ সালে ১৪ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ওয়েলিংটনে জন্মগ্রহণ করেন গিলক্রিস্ট। ২৫ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে অভিষেক হওয়ার পর টানা ১২ বছর দেশটির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গিলির ওয়ানডে অভিষেক হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

 

১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহ্যবাহী ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যাগি গ্রিন পরার সৌভাগ্য লাভ করেন গিলক্রিস্ট। সেই বছরের নভেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষ প্রথম টেস্ট খেলেন তিনি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উৎপত্তি ঘটেছে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ দিকে। তবে ২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইতিহাসের প্রথম ২০ ওভারের ম্যাচেই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন গিলি।

 

ওয়ানডেতে ১০ হাজার রানের অভিজাত ক্লাবে নাম লেখানোর বেশ ভালো সুযোগ ছিল গিলক্রিস্টের সামনে। কিন্তু দল ও তরুণদের কথা ভেবে অবসর নেন তিনি। এর আগে ২৮৭ ওয়ানডেতে (অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে ২৭০ ওয়ানডে) ৩৫.৮৯ গড়ে করেছেন ৯৬১৯ রান। এই ফরম্যাটে ১৬ সেঞ্চুরির পাশাপাশি তার আছে ৫৫ ফিফটি। এছাড়া ৪৭.৬০ গড়ে ৯৬ টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫৫৭০ রান করেছেন তিনি। সাদা পোশাকে গিলির আছে ১৭ সেঞ্চুরি ও ২৬ ফিফটি।

 

Gilchrist2

 

টি-টোয়েন্টি যুগের আগে যে কয়েকজন ব্যাটসম্যান বোলারদের তুলোধুনো করতে ভালবাসতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গিলক্রিস্ট। বাঁ-হাতি এই ব্যাটসম্যান অবসর নেওয়ার আগে পযর্ন্ত সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ড নিজের করে রেখেছিলেন। অবশ্য ২০১৫ সালে ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তি শ্রীলংকার উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারা রেকর্ডটি নিজের করে নেন।

 

তবে এখনো পযর্ন্ত টেস্ট ও ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেটের রেকর্ডটি অক্ষত রেখেছেন গিলি। টেস্টে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ১০০ ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড গড়েন তিনি। এছাড়া টানা তিন বিশ্বকাপের (১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭) ফাইনালে পঞ্চাশোর্ধ্ব রান করা একমাত্র ক্রিকেটার এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।

 

অবসর নিলেও এখনো ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার একজন হয়ে আছেন গিলক্রিস্ট। যতদিন ক্রিকেট থাকবে তাঁর কীর্তিগুলোই তাঁকে উজ্জ্বল করে রাখবে সবার কাছে।

 

Gilchrist4

 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডিসমিসালের মালিক হচ্ছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (৯০৫)। এক নম্বরে আছেন মার্ক বাউচার (৯৯৯)। উইকেটরক্ষকের ভূমিকায় খেলা আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকের রেকর্ডটা কুমার সাঙ্গাকারার (১৭,৫৯৯)। তবে খুব একটা পিছিয়ে নেই গিলক্রিস্টও; ১৫,২৫২ রান নিয়ে আছেন তৃতীয় স্থানে। দুই নম্বর জায়গাটা মহেন্দ্র সিং ধোনির (১৭,২৬৬ রান)।

 

ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলিয়ে সাঙ্গাকারা, ধোনি এগিয়ে থাকলেও টেস্টের রেকর্ডটা আজও গিলক্রিস্টের (৯৬ টেস্টে ৫৫৭০ রান) দখলে। দুই নম্বরে আছেন মার্ক বাউচার (১৪৭ টেস্টে ৫৫১৫ রান)। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিয়মিত কিপিং করলেও টেস্টে সাঙ্গাকারা কখনোই রেগুলার উইকেটকিপার ছিলেন না। পুরো ক্যারিয়ারে কিপিং করেছেন মাত্র ২৯ টেস্টে, অপরদিকে গিলক্রিস্ট কিপিং করেছেন একটানা ৯৬ টেস্টে যা একটা রেকর্ডও বটে!

 

রান এবং ডিসমিসালের দিক থেকে শীর্ষস্থানটা ধরে রাখতে না পারলেও সেঞ্চুরিতে আবার গিলিই সবার চেয়ে এগিয়ে। সর্বোচ্চ ৩৩টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি নিয়ে কিপার-ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শীর্ষে আছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ২৯টি সেঞ্চুরি নিয়ে সাঙ্গাকারার অবস্থান দ্বিতীয় (পুরো ক্যারিয়ার নয়, শুধুমাত্র উইকেটকিপার হিসেবে খেলা ম্যাচে)।

 

Gilchrist3

 

আসলে ব্যাটিং এবং কিপিং দুই বিভাগেই সমান দক্ষতা ও ধারাবাহিকতা ছিল বলেই নিজেকে গ্রেটদের কাতারে নিয়ে যেতে পেরেছেন গিলক্রিস্ট। তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ক্রিকেট ইতিহাসে খুব কম ব্যাটসম্যানই আছেন যারা কিনা গিলক্রিস্টের মতো এত স্বচ্ছন্দে বল পেটাতে পেরেছেন। বলা যায় হার্ডহিটিংকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন তিনি।

 

ক্রিকেটের সব ফরম্যাটেই গিলক্রিস্টের স্ট্রাইক রেট ছিল ঈর্ষনীয়। টেস্টে ৮১.৯৮, ওডিয়াইতে ৯৬.৯৪ ও টি২০-তে ১৪১.৬৭ স্ট্রাইক রেটই বলে দেয় ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি ঠিক কতটা বিধ্বংসী ছিলেন। উল্লেখ্য, টেস্টে গিলির চাইতে বেশি স্ট্রাইক রেট আছে শুধুমাত্র বীরেন্দর শেবাগ (৮২.২৩) এবং শহীদ আফ্রিদির (৮৬.৯৭)।

 

টেস্ট ক্রিকেটে ১০০ ছক্কা মারা প্রথম ব্যাটসম্যান হলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। টেস্টের তৃতীয় দ্রুততম (৫৭ বল) সেঞ্চুরি এবং অষ্টম দ্রুততম (২১২ বল) ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটাও গিলির দখলে৷ ওয়াসিম আকরাম একবার বলেছিলেন, ‘গিলক্রিস্টকে বল করে কখনোই স্বস্তিতে থাকতে পারতাম না। ওভারের সেরা বলটাতেও বাউন্ডারি মেরে দিতে পারত ও।’

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...