সবার প্রিয় সাবিত্রী

তাঁরা ছিলেন দশ বোন। তিনি সর্বকনিষ্ঠা। একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন তাঁর জন্মের পর কোন আনন্দধ্বনি বা উলুধ্বনি কেউ তো দেয়ইনি বরং তার ঠাকুমা চোখের জল ফেলে নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করেছিলেন কারণ তিনি আশা করেছিলেন যে তার পুত্রের দশম সন্তানটি হয়তো পুত্র সন্তান জন্মাবে। তাই তার এই পৃথিবীতে আগমনই ছিল সকলের কাছে অনভিপ্রেত।

Sabitri-Chattopadhyay1

কিন্তু বিধাতা বোধহয় অন্যরকম কিছু ভেবে রেখেছিলেন এবং এই মেয়ের কপালে যশের জয়তিলক পরিয়ে দিয়েছিলেন। ভাগ্যের এমন অদ্ভুত পরিহাস যে সেই মেয়েটির বাবা শ্রীশশধর চট্টোপাধ্যায় পরবর্তীতে পরিচিত হয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত এই কন্যার পরিচিতিতেই। সেদিনের সেই অবিভক্ত বঙ্গের কুমিল্লার এক অখ্যাত গ্ৰামে বাবা মায়ের চূড়ান্ত নিরাশার সন্তান হিসেবে জন্ম নেওয়া শিশুকন্যাটিই ভবিষ্যতের বিখ্যাত অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

১৯৩৭ সালে তাঁর জন্ম হয়। বাবা ছিলেন স্টেশন মাস্টার। তাঁদের আর্থিক অবস্থা খারাপ না থাকলেও দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। সাবিত্রীর বাবা প্রথমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সাবিত্রী এবং তাঁর ঠিক উপরের দিদিকে। তাঁরা দুজন এসে উঠেছিলেন কলকাতায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

Sabitri-Chattopadhyay2

কিন্তু সেখানেও চূড়ান্ত উপেক্ষা ও অবহেলার শিকার হতে হয় তাঁদের। বহুদিন অনাহারে অথবা অর্ধাহারে থাকতে হয়েছিল তাদের দুই বোনকে। সেই সময় সাবিত্রীর পরিচয় হয় অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি কিশোরী সাবিত্রীকে নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন।

তাঁর হাত ধরেই অভিনয় জগতে প্রবেশ করলেন সাবিত্রী। প্রথম অভিনয় করলেন নতুন ইহুদি নাটকে। নাটকে অভিনয় করতে করতেই সিনেমায় অভিনয়ের ডাক আসে। ছবির নাম পাশের বাড়ি। মাসিক দুশো টাকা মাইনে পাবেন এই চুক্তিতে তিনি অভিনয়ে রাজি হন। কিন্তু সেই টাকাও তিনি পুরো পাননি।

কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করল সাবিত্রীর এই পাশের বাড়ি ছবি থেকেই। সেই সময় তাঁরা এত দরিদ্র ছিলেন যে এই ছবির শুটিংয়ের জন্য তিনি প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে শাড়ি চেয়ে এনেছিলেন পরার জন্য। পরার মতো সেরকম ভাল শাড়িও ছিল না তাঁর। শুটিং করতে বাসে যাতায়াত করতে হতো তখনও তাঁকে।

Sabitri-Chattopadhyay3

কিন্তু "পাশের বাড়ি" ছবি হিট করে এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় পরপর ছবিতে অভিনয়ের ডাক পেতে থাকেন। ততদিনে তাঁর পুরো পরিবার কলকাতায় চলে এসেছে। সম্পূর্ণ আর্থিক দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। নিয়তির কী অদ্ভুত পরিহাস তাই না? যে মেয়েটির জন্মই তাঁর পরিবারের কাছে চূড়ান্ত অনভিপ্রেত ছিল সেই মেয়েটির উপরেই তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্ভর করতে হয়েছিল।

জীবনে প্রেম এসেছিল তাঁর। মহানায়ককে ভালবেসেছিলেন তিনি। কিন্তু বিবাহিত উত্তমকুমারের সংসার ভাঙতে চাননি কখনো। সারাজীবন অবিবাহিত রয়ে গিয়েছেন এই অসামান্যা অভিনেত্রী। মহানায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে দর্শককে উপহার দিয়েছেন বহু হিট ছবি। মৌচাক, ধন্যিমেয়ে, ভ্রান্তিবিলাস এই ছবিগুলি এখনো দর্শকদের মনে অমলিন হয়ে আছে।

অসাধারণ অভিনেত্রী তিনি। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তরুণ কুমারের মতো দিকপাল অভিনেতারাও বারেবারে বলেছেন এই কথা। একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। ২০১৪-তে পেয়েছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। কমেডি অভিনয়েও তুখোড় এই অভিনেত্রী। এই তিরাশি বছর বয়সেও আমাদের অর্থাৎ দর্শকদের মুগ্ধতার মাত্রা বাড়িয়েই চলেছেন আমাদের সকলের প্রিয় অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...