ছেলেটির বাবা ছিলেন আর্মির ডাক্তার। পাঞ্জাব, লাহোর, করাচি, মিরাট... পুরো চাকরি জীবনেই বাইরে বাইরে পোস্টেড ছিলেন। তাই সেই ছেলেটির শৈশব কেটেছে বাবার সঙ্গে সঙ্গে, বাংলার বাইরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে। তাই ছোট থেকেই খুব ভাল হিন্দি বলতে শিখে গিয়েছিল ছেলেটি।
বাবা চাইতেন ছেলে তাঁর মতো ডাক্তার হোক। কিন্তু ছেলের নেশা অভিনয়ের। তেরো বছর বয়সে মাতৃহারা হয় সে। বাবা তাকে মামাবাড়িতে রেখে যান। কিন্তু মামারা ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল। ছেলেটি বাড়িতে লুকিয়ে একটা সিনেমায় অভিনয় করল। কিন্তু সেই খবর মামারা পেয়ে গেলেন। ছেলেটি অভিনয় ছাড়তে রাজি হল না। মামাবাড়ি ছাড়তে হল তাকে। বাবার কাছেও কোনও সমর্থন পেল না সে। যাকে বলে 'পথে পথে ঘুরে বেড়ানো' তাইই করতে হল তাকে। একটা দুটো ছবিতে ছোট ছোট পার্ট- এইটুকুই। ১৯৫৮-এ মুক্তি পায় তার প্রথম অভিনীত ছবি 'ডাকহরকরা'... এই ছবিতে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছিল সে। সেই সময় মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেল সে... না না, সুযোগ পেলেন তিনি...নায়ক হিসেবে। ছবির নাম মায়ামৃগ। নায়িকা মালা সিনহা। সুপার হিট হয়েছিল এই ছবি। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। শুরু হল তাঁর জয়যাত্রা। তিনি...অতি সুদর্শন অভিনেতা বিশ্বজিৎদেব চট্টোপাধ্যায় আমরা যাঁকে 'বিশ্বজিৎ' নামেই চিনি।
এরপরও তিনি কমার্শিয়াল নাটকে অভিনয় করতেন। তখন রংমহলে অভিনয় করছেন তিনি 'সাহেব, বিবি, গোলাম' নাটকে। তাঁর কথায় "এক দিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এলেন ব্যাকস্টেজে আমার সঙ্গে দেখা করতে। বললেন, "ওহে বিশ্বজিৎ তোমায় এবার স্টেজ ছাড়তে হবে। আমি একটা হিন্দি ছবি করছি। সেখানে তুমি হিরো।" কিন্তু তিনি তখন নাটকের জন্য চুক্তিবদ্ধ। তবে রংমহল তাঁকে আটকে রাখেনি। তিনি পৌঁছলেন বম্বে। ছবির নাম "বিশ সাল বাদ"। হিরো বিশ্বজিৎ। সেই ছবির গান "কহিঁ দীপ জ্বলে কহিঁ দিল" আজও জনপ্রিয়।
তাঁর সময়কার হিন্দি ছবির নায়কদের মধ্যে প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে আসত তাঁর নাম। হিন্দি তো জানতেনই, তার সঙ্গে শিখেছিলেন হর্স রাইডিং, ফেন্সিং, বক্সিং... নানা স্পোর্টস। উর্দু শিখেছিলেন। বব দাসের কাছে নাচ শিখেছেন। তাঁর নিজের কথায় "অল ইন্ডিয়া লেভেলের হিরোদের যা যা প্রয়োজন, সে ভাবে নিজেকে গ্রুম করেছিলাম"...
বেশ কিছু হিট বাংলা ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। তার মধ্যে দুই ভাই, চৈতালি, নতুন ফসল, কুহেলী (তরুণ মজুমদার পরিচালিত), বাবা তারকনাথ উল্লেখযোগ্য।
খুব ভাল গানও গাইতেন বিশ্বজিৎ। পৃথিবীর নানা দেশে পারফর্ম করেছিলেন। লন্ডনে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে, বার্মিংহামে আশা ভোঁসলের সঙ্গে গান গেয়েছেন। মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই মঞ্চে গান গেয়েছেন। তবে তার কোনও প্রথাগত ট্রেনিং ছিল না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোট ভাই সঙ্গীত পরিচালক অমল মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর প্রথম গান রেকর্ডিং। প্রথম গান ‘কখন নদীর তীরে সন্ধ্যা নামবে’। সেই গান হিট হওয়ার পরে বেশ কয়েক বছর পুজোয় তাঁর গান বেরত।
বিশ্বজিৎ শুধু একজন বিখ্যাত অভিনেতা নন, তিনি এক বিখ্যাত পুত্রের পিতাও। পুত্র প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্রের একজন নামী অভিনেতা।
সম্প্রতি বিশ্বজিৎ চুরাশি বছরে পা দিলেন। আসুন আমরা দীর্ঘ জীবন কামনা করি এই "চিরতরুণ" অভিনেতার।