অভিনেতা ভানুর বিপ্লবী জীবন

সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাংলার হাস্যকৌতুক অভিনয়, এই দুটিই আজ সমার্থক। কি চিনতে পারলেন না তো?

 

আরে, সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন ভানু।হ্যাঁ ঠিকই ধরসেন, আপনাগো ভানুর কথাই কইতাসি। সেই কাল্ট হয়ে যাওয়া সংলাপ 'মাসিমা মালপোয়া খামু' মনে পড়ে? সেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই বলছি।

 

bhanu 1

 

যাঁর অভিনয় মুগ্ধ করত তামাম বাংলাকে, যাঁর নিজস্ব বাচনভঙ্গিতে মেতে থাকত আপামোর বাংলার শ্রোতা দর্শক। প্রায় তিনশো'র বেশি ছবিই করেছেন তিনি তাঁর অভিনয় জীবনে। এছাড়াও বানিয়েছেন অজস্র কমিক, কাঁপিয়েছেন মঞ্চ। মাতিয়েছে গ্রাম-বাংলার যাত্রার আসর। ওপারের বাঙাল ভাষাকে করে তুলেছিলেন শহুরে বাঙালির কাছের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা।

 

বাংলায় খুব কম অভিনেতার নামে ছবি হয়েছে, বলা ভালো ভানুর ব্র্যান্ড নেমেই ছবি হত ও চলত। যেমন ভানু পেল লটারী, ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিসটেন্ট। অভিনেতা ভানুর জীবনের প্রথমার্ধের অনেকটা সময় কেটেছে ওপার বাংলার বিক্রমপুরে। সেখানেই কিশোরবেলা কাটিয়েছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

 

ছাত্রাবস্থায় ভানু যেমন ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, কবি জসীমউদ্দিনের প্রিয়পাত্র, অন্য দিকে তেমনই তিনি ছিলেন দেশপ্রেমী, স্বদেশিও করতেন নিয়মিত। কিশোর বয়স থেকেই বুকের মধ্যে নিষিদ্ধ বই, রিভলভার নিয়ে পাচার করতেন তিনি। জামার মধ্যে, টিফিন বাক্সে অস্ত্র নিয়ে পৌঁছে দিতেন বিপ্লবীদের।

 

বিপ্লবী সমিতির পত্রিকাও তিনি বিক্রি করতেন, বিলি করতেন বিপ্লবী সংগঠনের প্রচারপত্র, তাও গুপ্তসমিতিগুলির মতোই গোপনে। গোপন ভাবে নানান বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যেতেন।

 

রাইটার্স বিল্ডিং-এ সেই অলিন্দ যুদ্ধের কথা মনে আছে। বিনয়-বাদল-দীনেশ, সেই তরুণ বিপ্লবী ত্রয়ের আত্মত্যাগ ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। এই তিন বিপ্লবীর মধ্যে অন্যতম এক দীনেশ গুপ্ত ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইডল। দীনেশ গুপ্তকে ‘গুরু’ মানতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কৈশোরবেলায় বিক্রমপুরে থাকাকালীন দীনেশ গুপ্তের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন ভানু।

 

bhanu 2

 

আবার সেই ভানুই এক সময় বাধ্য হয়ে বন্ধুর গাড়িতে, ব্যাকসিটের পাদানিতে শুয়ে এপার বাংলায় পালিয়ে এসেছিলেন। আবার বিপ্লবী অনন্ত সিংহের প্রতিও অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। অনন্ত সিংহ, তাঁর ছবির প্রযোজকও হয়েছিলেন। তবে প্রথম দুটো ছবিই ডাহা ফ্লপ, ‘শেষ পরিচয়’, ‘নতুন প্রভাত’ আবার অবশ্য পরেরটি সুপারডুপার হিট 'সাড়ে চুয়াওর'।

কিন্তু কেমন ছিল দীনেশ দা আর তাঁর অনুজপ্রতিম ভানুর সম্পর্ক। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত হয়ে উঠেছিলেন ভানুর কৈশোরের উপাস্য। এই ভানুই আগামী জীবনের হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সিনেমা-থিয়েটারে কমেডির কাল্ট, যার নেপথ্যেও দীনেশ গুপ্তের অবদান কিছু কম নয়।

 

ভানুর দিদি প্রকৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন লীলা রায়ের স্বদেশি দল ‘জয়শ্রী পার্টি’র সদস্যা। আর সেই সমিতিতেই দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয় ভানুর। সেই থেকেই ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। দীনেশ দা-র সাইকেলে চেপেই নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন ভানু। এমনকি দীনেশ দা-র আদেশে ঢাকার সদরঘাটে স্পাই হিসেবে গুপ্তচরবৃত্তির কাজও করতেন ভানু।

 

ভানুর দায়িত্ব ছিল সদরঘাটে কোথায় কোন পুলিশ আসছে যাচ্ছে, কে কোথায় আসছে, কোন সাহেব আসছেন, টাঙ্গা চড়ে কোনদিকে চলে যাচ্ছে ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ দীনেশ গুপ্তকে জানানো। ঢাকাইয়া গাড়োয়ানের পাশে বসে টাঙ্গা চেপে পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে অনুসরণ করতে করতে আঞ্চলিক ‘কুট্টি ভাষাটাও রপ্ত করে ফেলেন ভানু।

 

এর অনেক পরে ১৯৪৩ সালে ‘ঢাকার গাড়োয়ান’ নামে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিক স্কেচের রেকর্ড বেরোয়, যা পরোক্ষে এই সময়েরই ফলশ্রুতি। মাঝিমল্লা টাঙ্গাওয়ালাদের সঙ্গে ঘুরতেন ভানু যা পরবর্তীতে তাঁর হাস্যরসের উপাদান জুগিয়েছিল। অশিক্ষিত কুট্টিদের সেন্স অফ হিউমারই যে তাঁকে কমেডিয়ান হতে প্রেরণা জুগিয়েছিল তাও অকপটে আজীবন স্বীকার করে গিয়েছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। 

 

আট নয় বছর বয়স থেকেই দীনেশ গুপ্তের সান্নিধ্যে এসেছিলেন বালক ভানু। তাঁর দীনেশদার সঙ্গেই তিনি দেখেছেন বহু সিনেমা – লন চ্যানির হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম, চ্যাপলিনের গোল্ড রাশ। এছাড়াও লরেল হার্ডি, বাস্কার কিট্ন, হ্যারি ল্যাংডনের ছবিগুলি ভানুকে কমেডির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল, এসবই তিনি তাঁর দীনেশদার সঙ্গেই দেখেছিলেন।

 

bhanu 4

 

আত্মকথা’-য় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, কৈশোরেই স্বামীজির অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মুখে তিনি শুনেছিলেন সেই অতিচর্চিত কাহিনিটি। পাঞ্জাবে একটা মিটিংয়ে যেতে গিয়ে সাইকেলের চাকা ফেটে গেলে দীনেশ গুপ্ত নাকি সেই সাইকেল কাঁধে করে চার মাইল রাস্তা দৌড়ে ঠিক সময়ে পৌঁছেছিলেন মিটিং-এ। অনুশীলন সমিতির ত্রৈলোক্য মহারাজ, রাধাবল্লভ গোপ, মাস্টারদা, লোকনাথ বল প্রমুখদের কথা দীনেশদার মুখে শুনতে শুনতে দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছিলেন কিশোর ভানু।

 

তাঁর হৃদয়ের ভগবান হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্ৰিয় দীনেশ দা। ঢাকা শহরে দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে ঘুরতেন বলে মানুষ কিশোর ভানুকে অতিরিক্ত সমীহও করত। সেই দীনেশ গুপ্ত, ভানুর উপাস্য, তাঁর প্রাণের চেয়ে প্ৰিয়, শ্রদ্ধার দীনেশদা মারা যাবার পর দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন ভানু। স্তিমিত হয়ে পড়েছিলেন পুরোপুরি। স্বদেশী ও বিপ্লবী কার্যকলাপ থেকে সরে এসে পড়াশোনায় মনোনিবেশের চেষ্টা করতেন দীনেশদার আদরের স্নেহের ভানু। 

 

পরবর্তীকালে ভানু হয়ে ওঠেন প্রতিবাদী, তাঁর একরোখা চরিত্রের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। তাঁর কর্ম জীবনের ছত্রে ছত্রে প্রতিবাদী, অন্যায়ের সাথে আপোস না করা ভানুকে পাওয়া যায়। সারাজীবন ধরেই একপ্রকার প্রতিবাদী সত্তাকে তিনি নিজের মধ্যে বহন করে গিয়েছেন ভানু। হয়তো কিশোর বয়সে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তর সঙ্গই হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রতিবাদী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৈরি করেছিল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...