আক্ষেপ করতেন নিজের ‘কমেডিয়ান’ পরিচয়ে; ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

'নাগো মিনু আমাগো থার্মোমিটারও নাই, বার্নলও নাই'...

 'মাসিমা মালপো খামু'...

 'টিনের বাক্সে বারো টাকা'

 -এই জনপ্রিয় সংলাপগুলির সঙ্গে সঙ্গে তিনিও যে কখন জনপ্রিয় 'কৌতুক' অভিনেতা, 'টাইপ কাস্ট' অথবা বলা ভাল 'সিনোনিমাস টু কমেডি' হয়ে গিয়েছিলেন, তা তিনি নিজে যখন উপলব্ধি করেছিলেন, তখন তাঁর মত খাঁটি একজন অভিনেতার আক্ষেপ করা ছাড়া পিছনে ঘুরে তাকানোর আর কোনও সুযোগই বোধহয় অবশিষ্ট ছিলনা। শুধু কমেডিয়ান নয়, অভিনয়ের নিরিখে যে কোনও রোলেই ছিলেন অদ্বিতীয়, তা তিনি দর্শকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেননি, আর এ আক্ষেপ তিনি জীবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত করে গিয়েছেন। সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ‘ভানু’ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তাঁর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী।

FotoJet - 2019-08-26T142822.518

অবিভক্ত বাংলার মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে ১৯২০ সালের আজকের তারিখেই জন্মেছিলেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর নাম সাম্যময়। ডাকনাম ছিল ‘ভানু’। পরবর্তীকালে সাম্যময় থেকে 'ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়' নামেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৪০ সালে 'আর এস পি' নামে একটি বামপন্থী দল গঠিত হয়, সেখানে যোগ দেন ভানু। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি'স হাইস্কুল এবং জগন্নাথ কলেজে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে কলকাতায় আসেন ১৯৪১ সালে। কলকাতায় এসে আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি নামে একটি সরকারি অফিসে যোগ দেন এবং বালিগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে তাঁর বোনের কাছে দু'বছর থাকার পর টালিগঞ্জের চারু অ্যাভিন্যু-তে বসবাস শুরু করেন।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস ছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই। তিনিও ছিলেন স্যর-এর প্রিয় ছাত্র। কেক-পেস্ট্রির অত প্রচলন যখন ঘটেনি, সেসময় তাঁর মাস্টারমশাইয়ের জন্মদিনে কেক নিয়ে সোজা পৌঁছে যেতেন তাঁর বাড়ি। 

FotoJet - 2019-08-26T143915.012

 

বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত তাঁর মননে এক আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। দীনেশের মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন,- 'ভগবান! তোমার লীলা বোঝা ভার! একটা ব্যাপারে তোমার উপরে আমার ভীষণ রাগ- তুমি আত্মার নিজস্ব কোনও শক্তি দিলেনা কেন? দিলে দীনেশ দার আত্মা এখনকার বাকসর্বস্ব, অসৎ রাজনীতিওয়ালাদের মুন্ডু ছিঁড়ে ফেলতেন!' তিনি মনে প্রানে, কাজে কর্মে নিজেকে কমিউনিস্ট’ দাবি করতেন।

অভিনেতা-শিল্পী ভানু প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৪৬ সালে 'চন্দ্রগুপ্ত' নামে একটি নাটকে চাণক্যের ভূমিকায়। তবে শোনা যায় অভিনয়ে তাঁর হাতে খড়ি হয় ছোটবেলায়, ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীনই। সেসময় তিনি 'রণবীর' নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রে তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন 'চার্লি চ্যাপলিন' তাঁর টালিগঞ্জের বাড়িতে একটি বড়সড় চার্লি চ্যাপলিনের ছবিও ছিল। প্রায় প্রতিদিনই তিনি গ্রেট ডিক্টেটর' দেখতেন। কেঁদে ফেলতেন 'গোল্ড রাশ' ,'লাইম লাইট' দেখে।

FotoJet - 2019-08-26T142701.203

সিনেমায় আসার আগে মঞ্চে 'নতুন ইহুদী', 'বনবীর' নাটকে দাপুটে অভিনয় করতেন তিনি। ভানু কোনোদিনই ভাবেননি তিনি চলচ্চিত্রে  অভিনয় করবেন, অভিনেতা হবেন। বরং মঞ্চে অভিনয়ের দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল সবচেয়ে বেশি। এরই মধ্যে ১৯৪৬ সালে ভানু বিয়ে করেন বেতার শিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

FotoJet - 2019-08-26T142646.276

 

বিয়ের তিনদিন পরেই প্রথম ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান ভানু। ছবির নাম ছিল 'জাগরণ'। এরপর ধীরে ধীরে ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'মন্ত্রমুগ্ধ'(১৯৪৯), 'বরযাত্রী'(১৯৫১) এবং 'পাশের বাড়ি'(১৯৫২) তবে সিনেমার জগতে ভানুর প্রথম বাণিজ্যিক সফল ছবি নির্মল বসুর 'সাড়ে চুয়াত্তর'(১৯৫৩)। এই ছবিটি বাংলা কমেডি সিনেমার ইতিহাসে একটি অন্যতম মাইলস্টোন। এই ছবিতেই বাজিমাৎ করেন ভানু। এর পরের বছরই মুক্তি পায় 'ওরা থাকে ওধারে'। ১৯৫৮ সালে 'ভানু পেল লটারি'এবং 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ'। ১৯৫৯-এ মুক্তি পায় 'পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট', এই ছবিতে ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত '৮০তে আসিও না' ছবিটিতেও ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, এবং এখানেও বিপরীতে ছিলেন রুমা দেবী। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায়, 'মিস প্রিয়ংবদা' - যেখানে উনি চরিত্রের প্রয়োজনে মহিলা সেজে অভিনয় করেন। বিপরীতে ছিলেন লিলি চক্রবর্তী। 'ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট' মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। শেষ ছবি 'শোরগোল' মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪-তে।

FotoJet - 2019-08-26T142606.827

প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় তাঁর 'রুখে দাঁড়ানো' মনোভবের জন্যে একবার বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল তাঁকে। সিনেমার সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে প্রযোজকদের বিরোধিতা করে,অভিনেতাদের পাশে দাঁড়ানোয় দীর্ঘ পাঁচ বছরের জন্য 'ব্ল্যাক লিস্টেড' করা হয় তাঁকে। সেসময় কোনও কাজই পাননি তিনি। স্বভাবতই ভেঙে না পড়ে শুরু করেন গ্রামে-গঞ্জের মাঠে মাঠে যাত্রাদল নিয়ে যাত্রাপালা। বেশ কয়েকটি কৌতুকের অ্যালবামও আছে তাঁর, যার প্রথমটি হল ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত 'ঢাকার গাড়োয়ান'

FotoJet - 2019-08-26T142622.550

এই রেকর্ড নিয়ে একটা ঘটনা শোনা যায়, সুশীল চক্রবর্তী নামে এক উঠতি কমেডিয়ানের গল্প। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতেন। নবদ্বীপ হালদারের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করতেন। মোটামুটি নামডাক ছিল। শিল্পীমহলে অনেকেই চিনতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কমেডি করতে যেতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল রেকর্ড বের করার। কিন্তু HMV ভানু ছাড়া কাউকে নিয়েই আগ্রহী নয়। মাঝেমধ্যে সুশীলবাবু HMV-অফিসে যান আর প্রত্যাখ্যান নিয়ে ফিরে আসেন। শেষে একদিন মরিয়া হয়ে চলে গেলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। দরজা খুলে সুশীলবাবুকে দেখে ভানু প্রশ্ন করেন -' কী হইল ? তোমার মুখখানা ওমন শুকনা দেখাইতাসে ক্যান ?'

সুশীল - 'দাদা আপনাকে ছাড়া ওরা কারোর রেকর্ড করতে চায় না। আমার অনেক দিনের আশা আমি একটা রেকর্ড করি।'

তারপরই ভানু ফোনে HMV- এক কর্তাকে বলেন -
'এবার পূজায় আপনাগো ওখান থিকা রেকর্ড করুম না। আপনারা জুনিয়র আর্টিস্টদের লগে দুর্ব্যবহার করেন।'

HMV- সেই কর্তা তাঁকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। সব শুনে ভানু বলেন - 'হেইসব কথা আমি শুনতে রাজি নই। আমার শর্ত যদি আপনারা মানেন, তবেই পূজায় রেকর্ড করুম। নয়তো গুডবাই।'
শেষপর্যন্ত ভানুর ওই হুমকিতে কাজ হয়। রেকর্ড বেরোয় সুশীল চক্রবর্তীর। কমেডি রেকর্ড। এক শিল্পী রেকর্ড বের করতে নিজে সরে দাঁড়ানোর হুমকি রেকর্ড কম্পানিকে -এটা সে যুগেই সম্ভব ছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

তিনি ছিলেন কাঠ বাঙালওই বাঙাল অ্যাকসেন্টটাই শেষপর্যন্ত হাস্যরসের অন্যতম পরিভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যার প্রয়োগে 'ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়' হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

FotoJet - 2019-08-26T142719.843

একবার সত্যজিত্রায় ভানু সম্পর্কে বলেছিলেন, 'ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং যেখানে বিশেষ কিছু করার নেই সেখানেও করেছেন। আশ্চর্য এই যে, যাই করেছেন, তা বহরে ছোট হোক বা বড়ই হোক, তার মধ্যে তাঁর সাবলীলতার পরিচয় রেখে গেছেন। সর্বজন প্রশংসিত বিরল অভিনেতাদের মধ্যে ভানুবাবু একজন। আমার কোনো ছবিতে যে তিনি আজ পর্যন্ত অভিনয় করেননি তার মানে এই নয় যে, আমি তাঁর অভিনয়ের কদর করি না। প্রথমে মঞ্চে 'নতুন ইহুদী' এবং পরে চলচ্চিত্রে 'বসু পরিবার', 'সাড়ে চুয়াত্তর'-এর সময় থেকেই ভানুবাবুর সহজ বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করে এসেছে।'

চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিনহা’র কথায়, 'আমার মনে হয় ভানুবাবু কমেডিতে একটা ধারার প্রবর্তন করেছেন। ভাঁড়ামো না করে হাস্যরসের সারবস্তুটিকে সঠিক সপ্রতিভভাবে প্রযুক্ত করাই তাঁর লক্ষ্য। তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এক নতুন স্কুলিং সৃষ্টি করেছেন।'

অভিনেতা বিকাশ রায় বলেছেন, 'ভানু ইজ ইকোয়াল টু কমেডি প্লাস সিরিয়াস! আর আমি ইজ ইকোয়াল টু সিরিয়াস। লজিকের হিসাবে ভানু আমার চেয়ে বড় অভিনেতা। ওকে বলিনা বটে কিন্তু আপনাদের কাছে এই শেষ বয়সে কথাটা স্বীকার করে গেলাম।'

FotoJet - 2019-08-26T142748.885

অভিনেতা তরুণ কুমার মনে করেছেন, 'ভানুদা সুদক্ষ ক্ষমতাবান অভিনেতা। তবেই না লেখক তাঁর নামে গল্প লেখেন, 'ভানু গোয়েন্দা, জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট' এটা একটা জ্বলন্ত প্রমাণ। অনেক কৌতুক অভিনেতা আসবেন, যাবেন। কিন্তু চলচ্চিত্র, নাটক এবং যাত্রার ইতিহাসে ভানুদার নাম মুছে যেতে শতাব্দী পেরিয়ে যাবে। কেননা, ভানুদা, ভানুদাই।'

১৯৮৩ সালের মার্চ। ৬২ বছর বয়সে উডল্যান্ডস হাসপাতালে বেদনা-আক্ষেপ-নিজস্ব জীবনদৃষ্টি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন কিংবদন্তী এই শিল্পী। তিনি একটি কথাই বারবার বলতেন, 'আমাগো দ্যাশে এইটাই ট্র্যাজেডি, কমেডিয়ানরে লোকে ভাঁড় ভাবে!'

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...