কবিগুরুর কাছে গান লিখে দেওয়ার আর্জি জানালেন এক সৌম্যকান্তি পুরুষ। এই পুরুষটি একাধারে দেশপ্রেমিক, অন্যদিকে বিজ্ঞানের সাধক। তাঁর কাছে দেশসেবার মানে বিজ্ঞানচর্চার আরাধনা করা। সময়টা ১৯১৭ সাল। বিজ্ঞানের ওই সাধক তখন এই ভারতবর্ষকে বিজ্ঞান সাধনার তীর্থস্থান হিসেবে উন্নীত করার লক্ষ্যে ব্রতী। তাঁর দেশের আগ্রহী এবং মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে কোনভাবেই তাঁদের বিজ্ঞান-সাধনা থেকে বঞ্চিত না হয় তার উদ্দেশেই তিনি গড়ে তুললেন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বলা ভালো শিক্ষার মন্দির। বসু বিজ্ঞান মন্দির অর্থাৎ বোস ইনস্টিটিউট। বসু বিজ্ঞান মন্দিরকে সন্তানস্নেহে লালন-পালন করেছিলেন এই শিক্ষা-অঙ্গনের জন্মদাতা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর অনুরোধেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখেছিলেন "মাতৃ মন্দির পুণ্য অঙ্গন"। কবিগুরু তখন বিদেশে ছিলেন। কিন্তু বসু বিজ্ঞান মন্দির স্থাপনের চিন্তাভাবনা শুনেছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কাছ থেকে। আচার্যের ভাবনা স্পর্শ করেছিল কবিগুরুর হৃদয়। তাই সুদূর আমেরিকা থেকে গান লিখে পাঠিয়েছিলেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের জন্য। তারপর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু আলোচনা করলেন শিশির কুমার মিত্র, বীরবল সাহানি, শান্তি স্বরূপ ভাটনগর প্রমূখ গণ্যমান্য বিজ্ঞানের সাধকদের সঙ্গে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সকলেই আচার্যের এই চিন্তা-ভাবনার সঙ্গ দিলেন। ভারতবর্ষে শিক্ষার আলো পৌঁছনো শুরু হয়ে গেছে তখন, কিন্তু স্কুল ,কলেজ বা শিক্ষার পীঠস্থানগুলো ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত হয়নি তখনো। কোন নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে সাধনার জায়গাও তৈরি হয়নি সেভাবে। দেশের সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এই প্রতিষ্ঠান গড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সময় তৎকালীন সময়ের সমস্ত গুণী মানুষের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন আচার্য। কবিগুরুর রচিত গান, সকলের আশীর্বাদ সহযোগে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনায় ইতিবাচকতার সীলমোহর পড়ল। কিন্তু কেমন দেখতে হবে সেই অঙ্গন? যে স্বপ্ন সাজিয়ে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এই প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা ভেবেছিলেন, তেমন স্বপ্নের রংয়েই যেন আঁকা থাকে এই বসু বিজ্ঞান মন্দির। তাই আচার্য শরণাপন্ন হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, সঙ্গে যোগদান করলেন নন্দলাল বসু। চুনার থেকে গোলাপি মার্বেল পাথর এল। অবশেষে আচার্যের স্বপ্নের মন্দির গড়া শুরু হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নন্দলাল বসুর শিল্প চিন্তাভাবনার মেলবন্ধনে। স্থাপত্যবিদ এ এন মিত্র এই মন্দির গড়ার কাজ করেছিলেন আচার্যের ভাবনায়। অবশেষে ১৯১৭ সালের ২০শে নভেম্বর এই বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয়। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে "বাঙ্গালী" পত্রিকায় প্রথম বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ছবি ছাপা হয়। "ভারতবর্ষের উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম দেখতে হলে অবশ্যই বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ভাস্কর্য দেখা উচিত", এমনটাই বলা হয়েছিল ওই পত্রিকায়।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু স্বামী বিবেকানন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতার চিন্তাভাবনায় ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতীকচিহ্নের সঙ্গে তাঁদের ছবি যুক্ত করেছিলেন আচার্য। এমনকি বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রবেশদ্বারের সামনেও রয়েছে সিস্টার নিবেদিতার মূর্তি। মন্দির প্রতিষ্ঠা তো হয়েছে, কিন্তু সেখানে পুজো তখনও পর্যন্ত শুরু হয়নি। কবে এবং কীভাবে সেই মন্দিরে শিক্ষাদান, গবেষণার মত কাজ শুরু করা যায় সেই চিন্তায় মগ্ন আচার্য। আর শুরু করলেই তো হল না, ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে এই প্রতিষ্ঠানকে নির্ভরতার সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে সেই যোগসুত্র তৈরি করার চিন্তা-ভাবনাও আবিষ্ট করে রেখেছিল আচার্যকে। অবশেষে ১৯১৭ সালেই নিজের জন্মদিন অর্থাৎ ৩০শে নভেম্বর দিনটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বসু বিজ্ঞান মন্দির এর উদ্বোধন করলেন জগদীশচন্দ্র বসু। অগণিত ছাত্র-ছাত্রী, পরিচালন সমিতির লোকজন, সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তাঁর চিন্তাভাবনা। তাঁদের উদ্দেশে রাখলেন তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা "দ্য ভয়েজ অফ লাইফ"। সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বীরবল সাহানি, শিশির কুমার মিত্র, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর সহ আরো গুণী মানুষজন। সেই দিনের পর থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞান ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার নিরন্তর প্রয়াস করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান। সেই সময় এশিয়ার উন্নততম আধুনিক গবেষণাস্থল ছিল বসু বিজ্ঞান মন্দির। আজও বিজ্ঞান চিন্তা ভাবনার পথের দিশারী এই প্রতিষ্ঠান। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানের আলোয় মানুষের সেবা করে চলেছে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর গড়ে তোলা এই মন্দির।