ভবিষ্য পুরাণে বিক্রমাদিত্য বেতাল সংবাদ নামক একটি অধ্যায় রয়েছে, সেখানে রাজা বিক্রমাদিত্যের পূর্বজন্ম, দেবাদিদেবের তপস্যা করে তার ৩২ সিংহাসন প্রাপ্ত হওয়া ও বেতালের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা বর্ণিত আছে। ভারতবর্ষে যখন শকদের অত্যাচার শুরু হয় তখন এই অত্যাচারের হাত থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করার জন্য এক রাজার আবির্ভাব হয়। তার নাম বিক্রমাদিত্য। তিনি যেমন বুদ্ধিমান ছিলেন তেমনি ছিলেন তেজস্বী। সূক্ষ বিচার বিশ্লেষণ করে তিনি যে কোনও কাজ করতেন। বিক্রমাদিত্য পূর্ব জন্ম থেকেই ছিলেন যোগী,তাই পরজন্মেও তাঁর মধ্যে সেই স্বভাব বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।
আসলে দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশে এক অপ্সরা মানবী রূপে গন্ধর্বসেনকে বিয়ে করে মর্ত্যে ঘর সংসার করেছিলেন। সেই অপ্সরার যখন একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে তখন স্বর্গ থেকে পুষ্প বৃষ্টি হয়। যে কারণে ওই সন্তানের নাম হয় শিব বৃষ্টি। ছোট থেকেই সে শিবের তপস্যায় মগ্ন ছিল, পরবর্তীকালে সে যোগী হয়ে ওঠে। এই যোগী শিববৃষ্টি পরজন্মে বিক্রমাদিত্য হয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
জন্মের পর বিক্রমাদিত্য পাঁচ বছর বয়সেই বনে চলে যান তপস্যার জন্য। এরপর বনে গিয়ে তিনি ১২ বছর কঠোর পরিশ্রম করেন। দেবাদিদেব মহাদেব তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বরদান করেন। শিবের বরে তিনি মহাজ্ঞানী ও বলিয়ান হয়ে ওঠেন। এরপর রাজ্যে ফিরে তিনি রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। দেবাদিদেব মহাদেব ৩২ টি পুতুল দিয়ে একটি অপূর্ব সিংহাসন তৈরি করে বিক্রমাদিত্যকে আশীর্বাদ স্বরূপ দেন সেই সিংহাসনে বসেই তিনি রাজ্য পরিচালনা করতেন। পার্বতীর আদেশে বেতালরা সকলের অলক্ষে তাকে ঘিরে থাকত, যাতে কেউ তার ক্ষতি করতে না পারে।
উজ্জ্বয়িনীতে মহাকালেশ্বর শিবের পুজো করতে গিয়ে বিক্রমাদিত্য সেখানে একটি সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করেন এবং প্রচুর মণিমানিক্যে ভরপুর সেই প্রাসাদে শিবের প্রদত্ত সিংহাসন এনে রাখেন। সেই সিংহাসনে বসেই তিনি ধর্ম কথা আলোচনা করতেন। বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন পন্ডিতরাও তার সেই সভায় আসতেন। একদিন এই ধর্মসভা চলাকালীন এক ব্রাহ্মণ সেখানে এলেন। ব্রাহ্মণকে দেখে রাজা যথাযথ ভাবে আপ্যায়ন ও অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কিন্তু আসলে অতিথি হয়ে আসা এই ব্রাহ্মণ ছিলেন একজন বেতাল। যিনি বিক্রমাদিত্যের ধর্মবুদ্ধির পরীক্ষা নেবার জন্যই ব্রাহ্মণের বেশ ধরে এসেছিলেন।
ব্রাহ্মণরূপী বেতাল তখন বলল, রাজা মশাই আমি আপনাকে একটি পুরনো ইতিহাস বলব, আপনি মন দিয়ে শুনুন। শিবের অত্যন্ত পবিত্র ধাম হল বারানসী। বারানসীর রাজার নাম প্রতাপ মুকুট ও রানীর নাম মহাদেবী। তাদের একমাত্র পুত্রের নাম বজ্র মুকুট আর ওই রাজ্যের মন্ত্রিপুত্রের নাম হল বুদ্ধিদক্ষ। বজ্র মুকুট আর বুদ্ধিদক্ষের মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল, একদিন বজ্রমুকুট বন্ধুকে নিয়ে ঘোড়াতে করে শিকারে চলল। শিকারের পর দুজনেই প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পরল এবং দুজনে একটু বিশ্রামের বোধ করল একটু খোঁজাখুঁজির পর তারা একটি শিবালয় দেখতে পেল এবং তারা সেখানে বিশ্রাম করতে গেল।
শিবালয়ের পাশেই একটি সরোবর ছিল সেখানে তারা বসল। সেখানে রাজপুত্র ও মন্ত্রীপুত্র একজন সুন্দরী সহচরী পরিবৃতা এক অপরূপা মেয়েকে দেখতে পেলেন, মেয়েটিকে দেখে বজ্রমুকুট মুগ্ধ হল। সেই মেয়েটির মাথায় একটি পদ্মফুল ছিল। খোঁপা থেকে পদ্মফুলটিকে বের করে মেয়েটি কানে লাগায়, পায়ে ঠেকায় ও দাঁত দিয়ে একটু কাটে তারপর নিজের বুকের ওপর ফুলটিকে চেপে ধরে। বজ্রমুকুটকে এইরকম ইশারা করার পর মেয়েটি সেখান থেকে চলে গেল। বজ্রমুকুট একদৃষ্টে মেয়েটিকে দেখল তারপর বজ্রমুকুট রাজপ্রাসাদে চলে গেল কিন্তু সে আর আগের মত নেই। মেয়েটিকে দেখার পরে সে চঞ্চল হয়ে উঠেছে তার মুখে হাসি নেই, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা নেই, সে আহার পর্যন্ত ত্যাগ করল। সকলে চিন্তায় পড়ে গেল শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিদক্ষ অনেক বুঝিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসল কারণটা জানতে পারল।
সবকিছু জানার পরে বুদ্ধিদক্ষ বলল তোমার মন যাকে দেখে চঞ্চল হয়েছে তার নাম পদ্মাবতী, সে কর্ণাটকের রাজা দন্তবক্রের কন্যা, তার সঙ্গে তোমার মিলন কীভাবে হবে তাই তো ভাবছি। এরপর বুদ্ধিদক্ষ রাজা প্রতাপ মুকুটের কাছে আসল কথা গোপন করে বলল বজ্র মুকুটের একটা কঠিন অসুখ হয়েছে, সে আহার ত্যাগ করেছে, তার এই অসুখ সারাতে হলে কর্নাটকে চিকিৎসা করতে হবে। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে কর্নাটকে নিয়ে গিয়ে ওর চিকিৎসা ব্যবস্থা শুরু করি। রাজা সঙ্গে আরও সৈন্য সামন্ত পাঠাতে চাইলে মন্ত্রীপুত্র বললেন বেশি লোক গেলে অসুবিধা হবে, আমরা দুজনে দুটো ঘোড়ায় চড়ে সেখানে চলে যাব। এইভাবে কৌশল করে তারা সকলের অনুমতি নিয়ে কর্নাটকে গিয়ে উপস্থিত হল।
কর্ণাটকে এক বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে তারা সেখানে আশ্রয় নিল। সেই বৃদ্ধা ছিল রাজবাড়ির দাসী, বৃদ্ধার মন জয় করার জন্য প্রচুর ধন দিয়ে তাকে খুশি করে মা সম্বোধন করে ডাকতে লাগল মন্ত্রীপুত্র। রাত কেটে গেল পরের দিন সকালে ওই বৃদ্ধা যখন রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে যাবে তখন বুদ্ধিদক্ষ বলল, মা তোমাকে আমাদের জন্য একটি কাজ করতে হবে রাজকন্যা পদ্মাবতীকে গোপনে গিয়ে বলবে যে রাজকুমারের সঙ্গে তার সরোবরে দেখা হয়েছিল সে তোমার বাড়িতে আছে।
বৃদ্ধা এমনিতেই অর্থ পেয়েছে তার ওপর মা ডাক শুনে আর না বলতে পারল না। রাজবাড়ি এসে সে সব কথা রাজকন্যাকে বলে দিল, রাজকন্যা মুখে কিছু না বলে ইঙ্গিতে তার অন্তরের কথা জানিয়ে দিল। সে নিজের উড়ু থাবড়ে চিৎকার করে বলে উঠল 'যা যা' তারপর নিজেকে কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বুড়িকে দূর করে দিল। বুড়ি তো কিছুই বুঝতে পারল না সে সবকিছুর কী মানে, সে বুদ্ধিদক্ষকে এসে সব বলল। বুড়ির কথা শুনে রাজপুত্রের মন খারাপ হয়ে গেল কিন্তু বুদ্ধিদক্ষ বলল, আর তিনটে দিন অপেক্ষা কর। তোমার মনোবাসনা সিদ্ধ হবে। তিন দিন যাবার পর চতুর্থ দিন বুড়িকে রাজপ্রাসাদে যেতে দেখে বুদ্ধিদক্ষ বলল, মা গোপনে তুমি রাজকন্যাকে বলবে যে তাকে দেখবার জন্য রাজকুমার একেবারে ব্যাকুল। বাড়ি ফিরে এসে রাজকন্যার করা ইঙ্গিত বুদ্ধিদক্ষকে জানিয়ে দিল বুড়ি, বজ্র মুকুটের সেই সংকেত বোঝার মতো বুদ্ধি নেই কিন্তু বুদ্ধিমান বুদ্ধিদক্ষ রাজকন্যার ইঙ্গিত বুঝতে পারল। তারপর রাজপুত্রের যা যা করণীয় সব বলে দিল।
গভীর রাত্রে রাজপুত্র রাজ প্রাসাদের পশ্চিম দিকে যেতেই এক দাসী এসে তাকে একেবারে অন্দরমহলে নিয়ে গেল, রাজকন্যার সঙ্গে নিভৃতে মিলন ঘটল রাজকুমারের। এক এক করে ত্রিশ দিন কেটে যাওয়ার পর, বজ্রমুকুট পদ্মাবতীকে বলল, আমার একবার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা দরকার, তার বুদ্ধির জন্যই আমি তোমাকে পেয়েছি। প্রথম দিন থেকে তোমার হেঁয়ালি আমি বুঝতে পারিনি, ওই বন্ধুই তোমার হেঁয়ালি বুঝে আমাকে এভাবে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। এ কথা শুনে পদ্মাবতী বলল, এতদিন আমাকে তোমার বুদ্ধিমান বন্ধুর কথা বল নি কেন? একজন উপকারী বন্ধুর সঙ্গে খালি হাতে দেখা করতে যাওয়া উচিত নয়। আমি নিজের হাতে কিছু মিষ্টি তৈরি করে দিচ্ছি নিয়ে যাও। বজ্রমুকুট খুব খুশি হয়ে পদ্মাবতীর দেওয়া মিষ্টি নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বুড়ির বাড়িতে এল। অনেকদিন পর দুই বন্ধুর দেখা হল, কিন্তু রাজপুত্র বন্ধুকে মিষ্টি খেতে দিলে বুদ্ধিদক্ষ মিষ্টি না খেয়ে ফেলে দিল রাস্তায়। বুদ্ধিদক্ষের এই ব্যবহার দেখে রাজপুত্র রেগে গিয়ে বলল, আমি রাজপুত্র তোমার সম্মানীয় আমি যাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে যাচ্ছি সেও তোমার সম্মানীয়, তার পাঠানো মিষ্টি ফেলে দিলে কেন?- এই বলে রাজপুত্র রেগে গিয়ে বুদ্ধিদক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই সময় একটি কুকুর এসে সেই মিষ্টিগুলো খেয়ে তাদের চোখের সামনেই মারা গেল।
এই দৃশ্য দেখে রাজপুত্র অবাক হয়ে গেল বন্ধুকে আর কিছু বলতে হল না। বুদ্ধিদক্ষ তখন বললে, দেখলে তো, মিষ্টিতে বিষ দেওয়ার কারণ কী? রাজপুত্র লজ্জায় মাথা তুলতে পারল না। বন্ধুর হাত ধরে বলল, আর নয়, বন্ধু খুব হয়েছে। চল। ফিরে যাই রাজ্যে, তা না হলে আমাদের দুজনকেই ওই পিশাচিনীর হাতে মরতে হবে।
বুদ্ধিদক্ষ বলল, না আমরা যাব না, দুষ্টের সাজা হওয়া দরকার। তুমি আবার রাজকন্যার কাছে গিয়ে গোপনে তার একটি অলংকার নিয়ে আসবে যেন সে জানতে না পারে আর একটি ছোট ত্রিশূলের দাগ তার জানুতে দিয়ে আসবে। বুদ্ধিদক্ষের কথা মত রাজপত্র সব করল এরপর দুজনেই ছদ্মবেশ ধরল। মন্ত্রী পুত্র যোগীর বেশ ধরে ত্রিশূল হাতে রুদ্রমন্ডল শ্মশানে এসে যোগ সাধনায় বসল আর রাজপুত্র হল তার চেলা। রাজকন্যার অলংকার নিয়ে এসে রাজপুত্র বাজারে বেচতে গেল। রাজবাড়ির গহনা চুরি হওয়ার কথা স্বাভাবিক ভাবেই জানাজানি হয়ে গেল, বেচতে গিয়ে ছদ্মবেশে রাজপুত্র ধরা পড়ল। তাকে বিচারের জন্য ডাকা হল রাজাসভাতে। রাজপুত্রকে জিজ্ঞেস করা হল, যে এই অলংকার সে কোথায় পেয়েছে? বজ্রমুকুট বলল যে তার মহাযোগী গুরুদেব এটি তাকে দিয়েছে বিক্রি করার জন্য, তিনি এখন রুদ্রমন্ডল শ্মশানে যোগ সাধনায় রত রয়েছেন। এরপর ধরে আনা হল ছদ্মবেশে থাকা বুদ্ধিদক্ষকে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলল গতরাতে এক পিশাচিনী তার কাছে এসেছিল,তাকে সে এই অলংকার দিয়ে বশ করতে চেয়েছিল। একইসঙ্গে বুদ্ধিদক্ষ বলে, সে ওই পিশাচিনীর জানুতে তার হাতের এই ত্রিশূল দিয়ে দাগ এঁকে দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে পালিয়ে গেছে।
তার রাজ্যে পিশাচিনী আছে এই কথা শুনে মহারাজা মহা চিন্তায় পড়লেন, কে পিশাচিনী তা খুঁজে বার করার জন্য সারারাত ধরে তল্লাশি চলল, রাজকন্যার জানুতেই অবশেষে সেই ত্রিশূলের চিহ্ন পাওয়া গেল। রাজা বুঝলেন পদ্মাবতী সেই পিশাচিনী। রাজা নিজের মেয়েকে ক্ষমা করলেন না, তাকে রাজ্য থেকে বার করলেন। বেতাল এই কাহিনী শুনিয়ে বিক্রমাদিত্যকে প্রশ্ন করলেন, মহারাজ বলুন তো এই কাহিনীতে ধর্মত সবচেয়ে বেশি পাপ কে করেছেন?
বিক্রমাদিত্য বললেন, ধর্মের বিচারে রাজা দন্তবক্র সবচেয়ে বেশি পাপ করেছেন। রাজপুত্র বজ্র মুকুটের কোনও অপরাধ নেই। যথার্থ বন্ধুর কাজ করেছে মন্ত্রীপুত্র বুদ্ধিদক্ষ। কিন্তু রাজা দন্তবক্র সবথেকে বেশি অপরাধী কারণ তার মেয়ের বিয়ের উপযুক্ত সময় সে মেয়ের বিয়ে দেয়নি, ধর্ম অনুযায়ী সেটাই মহাপাপ। বিক্রমাদিত্যের উত্তর শুনে ব্রাহ্মণ বেশে থাকা বেতাল খুব খুশি হলেন।
তথ্যসূত্রঃ ভবিষ্য পুরাণ