প্রথম দিনের সূর্য
...রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে-
কে তুমি?
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-
কে তুমি?
পেলনা উত্তর।।
২২ শ্রাবণ জন্ম নেবেন মৃত্যুহীন রবীন্দ্রনাথ। ১১ শ্রাবণ লেখা হল কবিতাটি। চরম অসুস্থতা, তখন আর লিখতে পারেন না কবি। মুখে মুখে বলেন, লিখে নেয় আশেপাশে উপস্থিত থাকে যারা। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও নিজের সৃষ্টির প্রতি প্রবল অসন্তোষ তাঁর । বারবার বলেন, " কিছু ভুল আছে। তা থাক। ডাক্তার বলেছে অপারেশনের পর মাথাটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন লেখাগুলো নিয়ে আর একবার বসতে হবে। ঠিকঠাক করে নেওয়া যাবে।" মুখ বুজে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে বৃদ্ধ, ক্লান্ত, অসহায় রবীন্দ্রনাথ একা একাই আশ্চর্য হন, বলেন- "রোজ ভাবি এবার সব ফুরিয়ে গেল, আর কোন লেখা আসবে না। কিন্তু কী অদ্ভুত ভাবে আবার নতুন লেখা মাথায় এসে যায়। কী আশ্চর্য!"
আর মৃত্যুপথযাত্রী এই কবির কী লেখা আসছে তখন? কোন বোধ জন্ম নিচ্ছে শেষ সময়? তাঁর মনে পড়ছে প্রথম দিনের সূর্যের কথা। জীবনের শুরুতে যখন নিজের সত্তার সাথে প্রথম পরিচয় হবার শুরু তখন প্রশ্ন এসেছে 'কে তুমি?' আমি যে আসলে কে সে খোঁজ কখনো শেষ হবার নয়। তার একটা শুরু অবশ্য থেকে যায়। এখানে সূর্যের কথা বলে দিনের এফেক্ট আনলেন কবি। আলোর এফেক্ট। রবীন্দ্রনাথ যে আদতে আলোরই কবি। চোখের আলো না, অন্তরের আলো। আলো মানে তো জেগে ওঠা, প্রকাশিত হওয়া। সেই যে উপনিষদ শিখিয়েছে প্রকাশিত হতে, নিজেকে জানতে। হাজার বছর পরের কবিও সেই খোঁজের কথা লিখছেন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে।
প্রশ্নের কোন উত্তর আসেনি সেই প্রথম দিনে। তারপর "বৎসর বৎসর চলে গেল।" এটা কবিতার দীর্ঘতম লাইন। প্রবাহমান সময়। উপনিষদ থেকে লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ থেকে আমরা পর্যন্ত সবাইকেই যে কখনো না কখনো নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয়। নিজেকেই প্রশ্ন করি 'আমি আসলে কে? কোনটা ঠিক আসল আমি? কোনটা আমার পরিচয়?' প্রশ্ন ফিরে ফিরে আসে। আমরা উত্তর না পেয়ে নিজের সত্তার থেকে পালিয়ে বেড়াই।
এই কবিতা সেই মুহূর্তের তরে নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর কবিতা। এমনকি দিবসের শেষ সূর্য যখন পুনরায় প্রশ্ন নিয়ে আসছে শেষ বারের মতো, তখনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সময়ের ঝুলিতে নেই কোন সদুত্তর ! তবু গিয়ে দাঁড়ানো। নিজেকে খোঁজা।
সত্যি কত শত প্রশ্নের উত্তর মেলেনা একটা জীবনে। কত কথা অজানা থেকে যায় আজন্মের মতো। এমনকি নিজেকেও জানা হয় না পুরোপুরি। আমার মধ্যে বসবাস করছে কতগুলো আমি! এক এক জনের কাছে আমার এক একটা মুখ। এক এক মানুষের সামনে এক এক রকম মুখোশ আমার। এত সবের ভিড়ে নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলছি প্রতিপল... জ্ঞানে, অগোচরে।
এ কবিতা নিজের বোধ ও বোধি দিয়ে, মন ও মনন দিয়ে আত্মআবিষ্কার করার পথে চালিত করা কবিতা। এ আসলে নিজের সঙ্গে নিজের একান্ত বোঝাপড়া। সে বড় কঠিন কাজ। হয়তো সবথেকে কঠিন কাজ। তাই কবিতার লাইনগুলোও এমন এলোমেলো করে সাজানো। যেন এক তরঙ্গ। একবার উত্তরের কাছাকাছি এসে আবার বহু দূরে ছিটকে পড়া। আবার নতুন করে খোঁজা শুরু। যেন বা E.C.G graph । হৃদস্পন্দন। এবং কবিতা যত শেষ হয়ে আসে তরঙ্গ যেন এসে থামতে চায় এক নির্দিষ্ট বিন্দুতে। তলানিতে। যেন এরপর আর কিছু নেই। আর কোন আশা নেই উত্তর পাবার। নিজেকে পাবারও।
তবু খোঁজ চলতে থাকে। অন্তহীন এবং একা একা।