সভ্যতা না থাকলেও রয়ে গিয়েছে সৃষ্টি ও বংশপরম্পরা

পৃথিবীতে যে কটি সভ্যতার কথা জানি তা কোনও না কোনও নদীর তীর কেন্দ্রীক। কিন্তু মায়া সভ্যতা ছিল তার ব্যতিক্রম। ঘন জঙ্গলে তার বিকাশ ঘটেছিল প্রায় ৩০০০ বছরের বেশি সময় ধরে। এই সময় মায়ানরা কিভাবে এতো উন্নত সভ্যতা গড়ে তুললো, তা বর্তমান বিশ্বের বিস্ময়। উন্নত সভ্যতার অনেক ধারণাই কিন্তু মায়া সভ্যতার অবদান।

মায়া জনগোষ্ঠীর মানুষ মেক্সিকোর দক্ষিণে এবং উত্তর-মধ্য আমেরিকাতে বসবাস করতো। মেক্সিকোর দক্ষিণে চাপাস, তাবাস্কো এবং ইয়ুকাটান উপদ্বীপের কুইন্টানা রোওকাম্পেছ, এবং ইয়ুকাটান জুড়ে এর বিস্তৃতি ছিল। মধ্য আমেরিকার বর্তমান গুয়াতেমালা, বেলিজ, এল সালভাডোর এবং পশ্চিমী হন্ডুরাস জুড়ে মায়া সভ্যতা প্রসারিত হয়েছিল। যা মায়া অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। মধ্য মেক্সিকোতেও মায়ার প্রভাব লক্ষ করা যায়। এর বাইরেও অনেক অঞ্চলে মায়া সভ্যতার প্রভাবান্বিত শিল্প এবং স্থাপত্যের খোঁজ পাওয়া যায়, যা বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ফল।

বেলিজের কিউল্লোতে সম্প্রতি এই সভ্যতার ২৬০০ খ্রিস্ট –পূর্বাব্দের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে (কার্বন পরীক্ষার মাধ্যমে )। এই সভ্যতার পাথরের নির্মিত বাসস্হান, ভাস্কর্য , মূর্তি, বিশ্বের বিস্ময় এবং এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রসংশনীয়। এছাড়া হায়রোগ্লিফিক্সের ব্যবহার , ক্যালেন্ডারের ব্যবহার , জ্যোতির্বিদ্যায় এদের অবদান অনস্বীকার্য। জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ, জলাধার নির্মাণ , মৃত্তিকাশিল্প, বুনন সবেতেই মায়ানরা ছিল বিশেষ দক্ষ। তারা নিজেদের ভাষায় ক্যালেন্ডার বানাতে শুরু করে। পুরো আমেরিকা মহাদেশেই মায়া সভ্যতা একমাত্র প্রাচীন সভ্যতা যাদের নিজস্ব লেখ বা ভাষা ছিল। তারা লিখতে ও পড়তে পারদর্শী ছিল।

প্রথমদিকে এর সময় কাল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ । এর মধ্যে প্রাচীন কালে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনেক মায়া নগরী উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছায় । কিন্তু এই মায়া সভ্যতা নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। মায়ানদের আগমন কোনো অলৌকিক শক্তি প্রয়োগে হয়নি।

অনেক উপকথা থাকলেও প্রত্নত্বাত্তিক ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যানুযায়ী ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওল্মেক সভ্যতার শুরু হয়। তারা ছিল মায়াদের পূর্বপুরুষ। প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হন্ডুরাসের কোপায়েন এবং চালচুয়াপা শহরে তারা বসবাস করতে শুরু করে। মায়া সভ্যতার জনগন কখনোই অন্তর্ধান করেননি; প্রাচীনকালেও না, স্প্যানীয় বিজয়ীদের আগমনের সঙ্গেও না, এবং পরবর্তীতে যখন স্পেনীয়রা আমেরিকা মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করে তখনও না। আংপুরো মায়া অঞ্চল জুড়ে মায়া এবং তাদের বংশধরদের বিস্তার। অনেক মায়াভাষী তাদের প্রাথমিক ভাষা হিসেবে আজও মায়া ভাষায় কথা বলে। রাবিনাল আচি, আচি ভাষায় লিখিত একটি নাটক, যেটি ২০০৫ সালে ইউনেস্কো মানবতার মৌখিক ও স্পর্শাতীত ঐতিহ্যবাহীর শ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বর্তমানে মায়ানদের মাত্র ৪টি বইয়ের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আক্ষেপের বিষয় স্প্যানিশ বাহিনী যদি ১০০০ এর বেশি পুঁথি ও বই জ্বালিয়ে না দিতো -তাহলে ইতিহাস আরও স্পষ্ট হত, জানা যেত সহজে। ঐতিহাসিক সময়ানুযায়ী মায়া সভ্যতাকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। প্রি-ক্লাসিকাল (২৬০০ খ্ৰীপূর্বাব্দ-২০০ খ্রিস্টাব্দ), ক্লাসিকাল (২০০ A.D.- ৯০০ A.D.), পোস্ট -ক্লাসিকাল ( ৯৫০A .D.- ১৫৩৯ A .D )।

ক্লাসিকাল যুগে এল-মিরাদর শহর ছিল খুব উল্লেখযোগ্য ছিল। এই শহরে বিশাল স্থাপত্যের নির্মাণকার্য শুরু হয়। একই সাথে তারা আধুনিক পদ্ধতিতে জলসেচের সাহায্যে চাষাবাদ শুরু করে। এই সময় তারা টিকাল শহরে বসতি স্থাপন করে এবং পরে এটি মায়াদের বৃহত্তম শহরে পরিণত হয়। রাজধানীর পরেই এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম লিখিত শিলালিপি মায়া হায়ারোগ্লিফ চিহ্নিত হয়। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তারা একটি শিলাস্তম্ভের উপরে প্রথম মায়া জ্যোতিষ পঞ্জিকা তৈরি করে। ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থেকে ২৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাক-কলম্বীয় মেসোআমেরিকান টিয়োটিহকান শহরের নির্মাণ কাজ চলে। এই শহরের দ্বারা সৃষ্ট মায়া সংস্কৃতি অন্যান্য সংস্কৃতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। মায়ানরা প্রথমতম পিরামিড গঠন করে । ১০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি, মায়া শহরগুলোর একটি ব্যাপক পতন ও পরিত্যক্ত হয়। এটি প্রাকধ্রুপদী যুগের সমাপ্তির চিহ্নিত। এই সভ্যতা একক গোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় নি। অনেক শহর অনেক গোষ্ঠী কেন্দ্রিক সভ্যতা ছিল এখানে। যাদের মধ্যেই প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলতো। কিন্তু ভাষা, লেখার ধরণ, খাদ্যাভ্যাস এক ছিল। POPOL VUH কিশ ( মায়া অধিবাসী ) দের আগমনের ভিন্ন সূত্র উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন সময় সম্পর্কে মায়ানদের জ্ঞান ছিল সবচেয়ে বেশি। এদের বিশেষত্ব ছিল ৩ টি ক্যালেন্ডার ছিল। সোলার , সেক্রেড, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল লঙ কাউন্ট ক্যালেন্ডার যা ১১ই অগাস্ট ৩১১৪ B.C. থেকে আগামী ৬৩ মিলিয়ন বছরের ক্যালেন্ডার তৈরী করে রেখেছে। এই ক্যালেন্ডার সম্পূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। যা তৈরী হয়েছিল ১০০০ বছরের বেশি সময় ধরে সূর্য ও আকাশের অন্যান্য নক্ষত্র এর অবস্থান দেখে।

এই সময় জ্ঞান চাষাবাদ, বাণিজ্যিক ও জীবনযাত্রার উন্নতির সহায়ক হয়েছিল। প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের মতানুযায়ী এই সভ্যতার বিলুপ্তির নিদর্শন - দঃ আমেরিকার টিকাল (ন্যাশনাল পার্ক, গুয়াতেমালা ), যা ক্লাসিক মায়া শহরের ধ্বংসাবশেষ। এছাড়াও কলংকি , কোপানের মতো একসময়ের খুব বড় শহর এখন পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হয়েছে।

মায়াদের সভ্যতার বিলুপ্তি তাদের ক্যালেন্ডার সাইকেলের সঙ্গে মিলে যায়। কারণ লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার তাদের জীবনযাত্রার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। ক্যালেন্ডারের হিসেবে বলা যায় এই মায়া ক্যালেন্ডার এ ৫২২১ বছরে ১ সাইকেল (গ্রেট) এ সম্পূর্ণ হতো। ১টি গ্রেট সাইকেল ১৩ টি ভাগে বিভক্ত ছিল।

প্রতিটি ভাগে প্রায় ৪০০ বছর। প্রতিটি ভাগের নাম বাকতুন। প্রতিটি বাকতুনে তারা অনুষ্ঠান করলেও ১০ নম্বর বাকতুনে তারা কোনো অনুষ্ঠান করে নি। এটা ছিল ৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ ক্লাসিকাল সময়ের অন্তর্গত , শহর ছিল টিকাল। কিন্তু সেই সময়ের অনুষ্ঠানের কোনো চিহ্ন বা কোনো হ্যারোগ্ল্যাফিক্স পাওয়া যায় নি।

তবে ক্যালেন্ডারের সূত্র ধরেই কিছু উপকথা প্রচলিত আছে। যেমন এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন টিকালের ৭ টি পিরামিড, সঙ্গে constellation ও স্কাই গড এর তথ্য প্রচলিত। যেখানে বলা হয় মায়ানরা আকাশ থেকে এসেছিলো, সেখানেই চলে গেছে। আবার Alien Abduction theory অনুযায়ী সেখানে অপহৃত মানুষরা দাবি করেছে যে, ষ্টার সিস্টেম থেকে আশা এলিয়েনদের দ্বারা তারা অপহৃত হয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রাচীন পুরাতত্ববিদের মতে Alien Abduction theory ও ক্যালেন্ডার সিস্টেম এর সাথে তাদের হারিয়ে যাওয়া কিছুটা সম্পর্কিত। এই তত্ত্বের সবথেকে উল্লেখযোগ্য প্রমান ৬১৫-৬৮৩ পর্যন্ত কিং পাকালের ছবি, যা দেখে মনে করা হয় কোনো অ্যাডভান্স স্পেস শিপ এ রাজা পাকাল বসে আছেন। একটা পাথরের উপর খোদাই করা আশ্চর্য যানটি কোনো স্পেসশিপ, নাকে অক্সিজেন মাস্ক , হাতে কন্ট্রোলার ও যন্ত্রের নিচে দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে। তৎকালীন মায়া শিল্পীরা যা দেখেছে তাই এঁকেছে। এই থিওরি এর উপর ভিত্তি করে এনরিক দানিকার বইতে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই সবই থিওরিভিত্তিক। এর উল্টো দিকে আছে প্রত্নত্বাত্তিক প্রমান ও ইতিহাসের যোগসূত্র করলে বিলুপ্তির ৩ টি কারণ আছে : ১. প্রতিনিয়ত যুদ্ধ ২. প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট , ৩. খরা এদের একত্রিত করলে স্পষ্ট চিত্র পাবো।

ক্লাসিকাল শহর টিকালে ৬ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ লোক বসবাস করতো। যুদ্ধের প্রয়োজনে ২ লক্ষ মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। ফলে জঙ্গল কেটে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিণতি খরা। মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। এর সাথে যুক্ত হয় খাদ্য সংকট। ফলে প্রজাদের মধ্যেই অসন্তোষ বেড়ে যায়। যা রূপ নেয় গৃহযুদ্ধের। ফলে বেশির ভাগ মানুষ মারা যায় । বেঁচে যাওয়া মানুষ পাড়ি দেয় উত্তরের শহরগুলিতে - যেমন চিচান , উসমালি ইত্যাদিতে। ১০০০-১১০০ খ্রিস্টাব্দে প্রবল খরায় মায়া সভ্যতার ভর কেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটে। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে শেষ পর্যায়ে এই মাইগ্রেশন হয়. ১৪৪৮ স্প্যানিশরা আসে, সঙ্গে আনে একাধিক রোগ। যা আগামী ১০০ বছরে ৯০% জনসংখ্যা ধ্বংস করে। এই মায়া সভ্যতা প্রথম মেসো-আমেরিকান সভ্যতা যার সাথে স্প্যানিশদের সাক্ষাৎ হয়। কালের নিয়মেই সভ্যতার লুপ্তি ঘটে এক্ষেত্রেও তাই হয়। কিছু ভ্রান্তি আজ কথিত আছে যে ২০১২ সালের পৃথিবীর ধ্বংসের কথা মায়া ক্যালেন্ডারে ছিল। তবে প্রমান হিসেবে হায়রোগ্লিফিক্স তথ্য জানায় সেখানে ধ্বংস নয় নতুন কিছু সুচনার কথা ছিল যদিও তাদের উন্নত মানের জীবনযাত্রা, বাণিজ্য, ভাস্কর্য যে বিস্তারিত সৃষ্টি রেখে গেছে তা আজ ও অনুসন্ধানাধীন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...