ত্রয়োদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন ‘কোনারক’-এর সৃষ্টি-ধ্বংস-বিনির্মাণ

ভারতের ওড়িশা রাজ্যে পু্রী থেকে ৩৫ কি.মি এবং ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কি.মি দূরে এখনও রয়ে গিয়েছে ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোণারক মন্দির। মন্দিরটি প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের জ্বাজল্যমান নিদর্শন।

১২৫0 খ্রিস্টাব্দে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের প্রথম নরসিংহদেব উড়িষ্যা ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে নির্মাণ করেছিলেন। বিশাল রথাকৃতির সূক্ষ্ম কারুকার্যময় পাথরের চাকা, স্তম্ভ ও দেওয়াল সহ কাঠামোর একটি প্রধান অংশ এখন ধ্বংসাবশেষ। কোণারক মন্দির বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম, এ নিয়ে দ্বিধা নেই। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের তালিকাতেও রয়েছে এটি।

FotoJet (167)

মন্দির নির্মাণের প্রেক্ষাপটে দু’টি মত প্রচলিত রয়েছেপ্রথম মত অনুযায়ী, পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের (১০৭৮- ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দ ) নরসিংহদেব (১২৩৮ – ১২৬৪ খ্রিস্টাব্দ) প্রথম বাংলা জয়ের স্মারক স্বরূপ চন্দ্রভাগা নদীর তীরে প্রাচীন মিত্রাবনে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয়ত, পুরাণ মতে,  শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব ছিলেন ‌অত্যন্ত সুপুরুষ, কিন্তু কৃষ্ণের অভিশাপে তাঁর রূপ নষ্ট হয়ে যায়। হৃত রূপ ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি সমুদ্র তীরে তপস্যায় বসেন। কঠোর সাধনায় সূর্যদেবকে সন্তুষ্ট করে শাপমুক্ত হন। তিনিই সূর্য-আরাধনার জন্য সমুদ্রতীরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু প্রথম তত্ত্বটি ঐতিহাসিকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ লেখগুলি তেমন ইঙ্গিতবাহী।

FotoJet (169)

‘কোণারক’ নামটি সংস্কৃত ‘কোণ’ (কোনা বা কোণ) এবং অর্ক (সূর্য) শব্দদু’টির সমন্বয়ে গঠিত, যা সূর্য দেবকে উৎসর্গ করে। এই মন্দিরটি সূর্যের বিভিন্ন অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। স্মৃতিস্তম্ভটিকে ইউরোপীয় নাবিকরা ব্ল্যাক প্যাগোডা (কালো মন্দির) নামে অভিহিত করতো,  কারণ সূর্য বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ধূসর বেলেপাথর দিয়ে নির্মিত হওয়ায় মন্দিরটিকে দূর থেকে কালো দেখাত। এর বিপরীতে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরটি হোয়াইট প্যাগোডা (সাদা মন্দির) নামে পরিচিত ছিল। উভয় মন্দিরই নাবিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হতো। কোণারক ‘মন্দির’ হিসেবে পরিচিত হলেও আজ পর্যন্ত কোনোদিন এই মন্দিরে পুজো হয় নি। তবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল অষ্টধাতুর সূর্যমূর্তি। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজা প্রথম নরসিংহদেবের আদেশে ১২০০ একর জুড়ে বিস্তৃত এই মন্দির নির্মাণের জন্য ১২০০ শ্রমিক (প্রস্তর খোদাইকারী শ্রমিক) ১২ বছর ধরে কাজ করেছিলেন , খরচ হয় ১২ বছরের রাজস্ব, ৪০ কোটি স্বর্ণ মুদ্রা। পারিশ্রমিকের পরিবর্তে রাজা একটি শর্ত দিয়েছিলেন। শ্রমিকরা এই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে তাদের শিরচ্ছেদ করা হবে বলে ঘোষণা করেন তিনি।

FotoJet (168)

শর্ত ছিল ১২০০ কারিগর বিনা বেতন, বিনা ছুটিতে এই কাজ সম্পন্ন করবে। কিন্তু সমস্যা ঘটে মন্দিরের মঙ্গল ঘট স্থাপনের সময়। সময়সীমার দ্বিতীয় শেষ দিনে প্রধান স্থপতি বিসু মহারাণা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন কারণ রাজার দেওয়া সময় অনুযায়ী ঘট স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি নিশ্চিত ছিলেন ১২০০ জনের মৃত্যু অনিবার্য। এহেন পরিস্থিতিতে তিনি হঠাৎ দেখতে পেলেন একটি ছোট ছেলে তাঁর সন্ধানে আসছে। নাম ধর্মদাস। ছেলেটি এসে বিসু মহারাণাকে জানায় যে, সে তার ছেলে। দীর্ঘদিন মন্দিরের কাজে ব্যস্ত থাকায় কখনই সন্তানের মুখ দর্শনের অবকাশ হয়নি তাঁর। প্রথমবার ছেলেকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হলেও ছেলেকে জানান তাঁর  সমস্যার কথা। ১২ বছরের ধর্মদাস শেষ পর্যন্ত মঙ্গল ঘট স্থাপনে সক্ষম হয়। কিন্তু মৃত্যু ভয় ক্রমে তীব্রতর হয়ে ওঠে। কারণ শর্তানুযায়ী ১২০০ জনের বেশি শ্রমিক নিয়োগ হবে না। এই পরিস্থিতিতে উদ্বোধনের আগের রাতে ধর্মদাস নিঃশব্দে মন্দিরের চূড়া থেকে চন্দ্রভাগা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ১২০০ শ্রমিককে শিরশ্ছেদ থেকে রক্ষা করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়, ধর্মদাস মারা যাওয়ার পরে মন্দিরটি অপবিত্র হয়ে ওঠে এবং সেকারনেই সেখানে কোনও দিনই ঈশ্বরের উপাসনা হয় নি এখানে। পৌরাণিক মতে, ধর্মদাসই সূর্যদেবের অবতার ছিলেন।

FotoJet (166)

মন্দিরের প্রস্তর আনা হয়েছিল প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে খন্ডগিরি এবং উদয়গিরি থেকে। পুরো কাঠামোটি প্রস্তর নির্মিত হলেও সেগুলি লোহার বিম দ্বারা সংযুক্ত ছিল, যা এক বিশাল চুম্বক দ্বারা একসঙ্গে ধারণ করা হয়েছিল। যা ওজনে ৫ টনেরও বেশি ছিল। বিদ্যমান কাঠামোটি মাত্র ১২৭ ফুট উঁচু হলেও প্রকৃত মন্দিরটি ছিল ২২৭ ফুট উঁচু।

১৫০৮ সালে কালা পাহাড় মুসলিম সেনা নিয়ে আক্রমণ করলে মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়ে। ১৬২৬ সালে তৎকালীন রাজা নরসিমা দেব সূর্যদেবের মূল মূর্তি সরিয়ে পুরীর মন্দিরে রাখেন । ১৭৭৯ সালে অরুণ কুম্ভ সরিয়ে পুরীর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। যা এখন পুরীর মন্দিরের মূল দ্বার বা সিংহ দরজার সামনে রয়েছে। এর পর মারাঠারা মন্দিরের অনেক অংশ অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙে ফেলে। আগে মন্দিরের কাছে ছিল কোণারক বন্দর । মন্দিরের মাথায় থাকা শক্তিশালী চুম্বক যার দ্বারা আকৃষ্ট হতো জাহাজ। বিভ্রান্ত হতো জাহাজের কম্পাস। ফলে সব জাহাজ এই বন্দরেই আসত। ক্রমে পর্তুগিজ দস্যুরা চুম্বকটিও নষ্ট করে দেয় । ফলে মন্দিরটি ভারসাম্য হারিয়ে ভাঙতে শুরু হয়। ১৮০০ শতকে এই মন্দির তার গৌরব হারিয়ে পরিত্যক্ত হয়। মন্দিরের অনেকাংশ বালির নিচে চলে যায়। জঙ্গল , ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয়। ৩০০ বছর ধরে বালিরস্তূপের নীচে অনাদর ও অবহেলায় পড়ে থাকা এই সূর্য মন্দিরটিকে ১৯০৪ সালে বড়লাট লর্ড কার্জন উদ্ধার করেন৷ লোকচক্ষুর সামনে উন্মোচিত হয় কোণারক মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী, বিস্ময়কর ভাস্কর্যকীর্তি ও অনন্য শিল্প সম্ভার।

FotoJet (165)

উড়িষ্যা ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে নির্মিত মন্দিরটি সমুদ্র থেকে উঠে আসা সূর্যদেবের বিশাল রথ, তার সামনে রয়েছে সাত জোড়া ঘোড়াসূর্যবিজ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে এই মন্দির নির্মিত। নাট মন্দিরের ৩টি দরজা রয়েছে। ৩টি সময়ে সূর্যের উত্তরায়ণ ,দক্ষিণায়নের সময় সূর্যের এক এক সময়ের অবস্থানে এই ৩ দরজা দিয়ে সূর্যালোক নাট মন্দির থেকে প্রাথর্না মন্দির হয়ে, মূল মন্দিরে অবস্থিত সূর্য দেবের মুখে পড়ত। সাতটি ঘোড়া মানে সপ্তাহের সাত দিন। বারো জোড়া বিশাল চাকার ওপর পুরো মন্দিরটি নির্মিত। চব্বিশটি চাকা মানে চব্বিশ পক্ষ। চাকার কারুকার্য দর্শকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ। প্রতিটি চাকা একেকটি সূর্যঘড়ি। চাকার ভেতরের দাঁড়গুলো সূর্যঘড়ির সময়ের কাঁটা। আটটি দাড় মানে অষ্টপ্রহর। এখনো নিখুঁতভাবে সময় জানা যায় এই সূর্যঘড়ির সাহায্যে। মন্দিরের প্রবেশপথেই রয়েছে বিশাল দুটি সিংহের মূর্তি, যারা লড়াই করছে দুটি রণহস্তীর সঙ্গে। কথিত আছে টাকা ও ক্ষমতা মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নেয়। যা ধ্বংসের মূল কারণ। এছাড়া আছে ছায়া ও মায়া মন্দির, ভোগ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, কারিগরদের জল খাওয়ার কুয়ো ইত্যাদি। তবে নোনা হাওয়ায় ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে মন্দির প্রাঙ্গনে বসে ডান্স ফেস্টিভ্যাল। সেইসময় বহু দূর থেকে ছুটে আসেন বহু নৃত্যপ্রেমী মানুষ। তাছাড়া এই সৃষ্টি উপভোগের জন্য সারাবছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...