তাঁর স্বপ্ন সত্যি হল। সেই সঙ্গে কলকাতা গর্বিত হল, বাংলা গর্বিত হল, স্বদেশ গর্বিত হল।
কারণ তিনি যতটা কলকাতার, ততটাই সমগ্র বাংলার, ততটাই সমগ্র দেশের; আবার ততটাই সমগ্র বিশ্বেরও। আমাদের সেই ‘তিনি’ হলেন বিজ্ঞানী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।
তাঁর কাজ একই সঙ্গে স্থানীয় সমস্যা ছুঁয়ে বিশ্বজনীন সমস্যা নিয়ে। কেননা, তিনি মূলত যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করেন তা হল, জল। নদীর জল, ভূগর্ভস্থ জল—দুই নিয়েই। জলের সমস্যা, শুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা, জল দূষণের সমস্যা আজ তেল-সংকটের চেয়েও বড় সমস্যা সারা বিশ্বে।
এই সব সমস্যা নিয়ে অসাধারণ কাজ করার জন্য অভিজিৎবাবু ইতিমধ্যেই ইউনাইটেড কিংডমের ‘রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির ফেলো’ নির্বাচিত হয়েছেন, পঞ্চাশ বছরের কম বয়সী শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বিজ্ঞানীদের তালিকায় স্থান পেয়ে সম্মানিত হয়েছেন, ‘ন্যাশনাল জিওসায়েন্স পুরস্কার’ পেয়েছেন, বিজ্ঞানক্ষেত্রে ভারতের সর্ব্বোচ্চ পুরস্কার ‘শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার’ পেয়েছেন এবং অতি সম্প্রতি বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী ভূবিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠান ‘Geological Society of America’র ফেলো নির্বাচিত হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন।
শেষের সংবাদটিই তাঁর ‘স্বপ্ন’পূরণ ও আমাদের ‘গর্বের’ কারণ। কিন্তু কেন, তাইতো?
উত্তরটা ১৬ জুলাই ২০২১-এ ‘The KGP Chronicle’-এ প্রকাশিত অভিজিৎবাবুর বক্তব্য তুলে ধরলেই সুন্দরভাবে স্পষ্ট হবেঃ
“I am humbled and honored to have been elected as a Fellow to the Geological Society of America (GSA). GSA, estd. in 1888, is regarded as one of the oldest, largest and most prestigious International geoscience societies across the world. I further feel honored to be one of the first person from any Indian institute to be elected for this prestigious Fellowship. GSA has defined Fellowship as an honor that is bestowed on the best of our profession. GSA members are elected to Fellowship in recognition of a sustained record of distinguished contributions to geosciences (www. geosociety.org). So, being recognized by my peers, internationally, is certainly a dream coming true.”
দক্ষিণ এশিয়ার জলভূবিদ্যা (হাইড্রোজিওলজি)’র সবচেয়ে কৃতী-বিজ্ঞানী অভিজিৎবাবুর জন্ম দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে। সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুল থেকে স্কুলের পড়াশুনো শেষ করে তিনি আশুতোষ কলেজে ভূবিদ্যায় স্নাতক হন এবং স্নাতকোত্তর পাঠ নেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর আরও উচ্চতর পাঠ নিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যান।
সেখানে গিয়ে কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূবিদ্যার অন্যতম শাখা জলভূবিদ্যা নিয়ে দ্বিতীয়বার স্নাতকোত্তর সম্মান অর্জন করেন। এই পর্বে তিনি ‘ভূগর্ভস্থ জল ও পশ্চিম কেন্টাকির ওহিও নদীর জলে উদ্বায়ী জৈব যৌগ এবং তেজস্ক্রিয় সংক্রমণ’ নিয়ে গবেষণা করেন। তারপর ‘পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলের সঞ্চয় ও তাতে আর্সেনিক দূষণের প্রকৃতি’ নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
কানাডায় কয়েক বছর ফিজিক্যাল হাইড্রোলজিস্ট হিসেবে ‘অ্যালবার্ট জিওলজিক্যাল সার্ভে’-র সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রায় বারোখানা দেশের জলস্তর ও জলদূষণ নিয়ে কাজ করে এই ক্ষেত্রের আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে তিনি দেশে ফেরেন।
দেশে ফিরে ২০১০ সাল নাগাদ আইআইটি খড়্গপুরে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, এরপর রাজ্য ও দেশে সংঘটিত জলভূবিদ্যার গবেষণার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
তা সে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ সুন্দরবনই হোক বা প্রাচীন নগরী বেনারস, কিংবা হিমালয়ের লাদাখ অঞ্চল—সর্বত্রই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ভূগর্ভের জলস্তর নিরন্তর কমে যাওয়া এবং ক্রমাগত দূষণের ফলে তা পানের অযোগ্য হয়ে ওঠার বিষয়টিকে নিষ্ঠার সঙ্গে তুলে ধরেন।
সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভূগর্ভের জলে আর্সেনিক, কীটনাশক, জৈবযৌগের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দূষণের যে ভয়াবহ চিত্র সমীক্ষায় উঠে আসে, তা তাঁকে তো বটেই, গোটা বিশ্বকে সচকিত করে তোলে।
২০১৪ সালে এমনই এক প্রেক্ষাপটে অভিজিৎবাবু বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এর অধীনে ‘ওয়াটার সিকিউরিটি বিল’ আনার দাবি জানান দেশের সরকারের কাছে।
দাবিতে দেশের নদীগুলোকে বাঁচানোর কথা যেমন তাঁরা বলেন, তেমনি প্রতিটি নদীর দু’কিমি অব্দি পরিচ্ছন্ন প্লাবনভূমি সুনিশ্চিত করার আবেদন জানান সরকারের কাছে। বলেন যে, প্লাবনভূমির পরিচ্ছন্নতা যদি সুনিশ্চিত করা যায়, তাহলে দূষণহীন পানীয় জল সহজেই সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে।
তাঁদের এই পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ ও ‘নমামী গঙ্গে’র মতো দুটি প্রকল্প শুরু করেন। গোষ্ঠীগত প্রচেষ্টার বাইরে এই প্রকল্প দুটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে অভিজিৎবাবুর যথেষ্ট গবেষণা ও সক্রিয় অবদান রয়েছে।
অভিজিৎবাবু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ফ্লুরিড টাস্কফোর্স’-এরও সদস্য। স্বচ্ছ পানীয় জল সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে সরকারের ‘ভিজন ২০২০’ প্রকল্প তাঁরই ভাবনা ও উদ্যোগেরই ফসল।
এছাড়া সমীক্ষার মাধ্যমে ভূগর্ভের জলস্তর সংরক্ষণ, তার সমৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়ে নানান পরিকল্পনা তিনি ইতিমধ্যেই প্রণয়ন করেছেন, করে চলেছেন। তাঁর পরিকল্পনায় সরকারী নীতি নির্ধারিতও হচ্ছে। স্বচ্ছ পানীয় জল ঘরে ঘরে বা গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
তারপরেও একটা প্রশ্ন এসেই যায়, সুবৃহৎ কর্মযজ্ঞের মাঝে দাঁড়িয়ে অভিজিৎবাবু ভাবছেন, সরকারকে ভাবাচ্ছেন; কিন্তু আমরা ভাবছি কি?
ভাবছি না বলেই আমরা সচেতন হচ্ছি না, যথেচ্ছ ভূগর্ভের জল নষ্ট করছি, সেই জল সম্পুরণের কোন চেষ্টাই করছি না! এটাই বাস্তব।
অভিজিৎবাবু আমাদের সচেতন করতে চান, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে চান। এটা তাঁর অন্যতম স্বপ্ন। আসুন না, এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত হতে দিই...
তথ্যঋণ : ‘The KGP Chronicle’--16th July 2021.