কুর্নিশ অ্যানি

১৪ বছর আগের কথা সেসব। কাঞ্জিরমকুলম কলেজের প্রথম বছর। সোশিওলজি অনার্স।
সাংঘাতিকভাবে প্রেমে পড়ল মেয়েটা। যাকে বলে অন্ধ প্রেম এ একেবারে তাই।
১৮ পূর্ণ হতে না হতেই প্রেমিককে দুম করে বিয়ে। বাড়ির অমতেই।

দু'বছর বেশ গেল। পুত্র সন্তান এল। কিন্তু তারপরেই যেন আমূল বদলে গেল ছবিটা।
একদিন মাঝ রাত্তিরে ছেলে সমেত রাস্তায় মেয়েটাকে বের করে দিল তার স্বামী। একদা প্রেমিক।
ছেলের তখন সবে করে আটমাস। মাথার ওপর থেকে রাতারাতি নেই হয়ে গিয়েছিল ছাদটা।

আমার গল্পটা এভাবেই শুরু হয়েছিল। কথাগুলো অ্যানি শিভা'র। কেরলের ভারকালা থানার সাব-ইন্সপেক্টর। এই বছরের ২৫ জুন দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তিনি।

AnnieShiva1

টানটান চেহারা, বয় কাট চুল, রোগা-পাতলা ছটফটে স্বভাব, বিদ্যুৎ ক্ষিপ্র গতি তাঁকে আলাদা করে জাত চিনিয়ে দেয়।
দেখে কে বলবে চোদ্দ বছর আগে এই মেয়েই এলাকায় লেবুর জল বিক্রি করত!
শুনলে মনে হবে গল্প। সিনেমাও হার মানবে। কিন্তু সব সত্যি।
কেরলের ভারকালা থানার এই সাব-ইন্সপেক্টর আজ দেশের হাজার হাজার মেয়ের কাছে একরোখা জেদের উদাহরণ।
কেমন ছিল সেই লড়াই। জানতে হলে পিছতে হবে।
"আমার ছেলে তখন আটমাস। আর আমি থার্ড ইয়ার। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। একটুখানি ঠাঁই চাইতে বাবার বাড়ি গেলাম। কিন্তু আশ্রয় দিল না"।
মাথায় কিছু ঢুকছিল না। কোথায় যাব। কী করব। শুধু জানতাম যেভাবেই হোক পরীক্ষাটা আমায় দিতে হবে..."
শেষ পর্যন্ত অ্যানির দিদিমা তাঁর বাড়িতে কোনওরকমে একটু আশ্রয় দিলেন।
পড়াশোনা, ছেলে আর জীবনে জিইয়ে থাকা এই তিন ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। পেটের দায় বড় দায়। মসলাপাতি, সাবান বিক্রি করতে শুরু করলেন অ্যানি। দরজায় দরজায় ঘুরে সে বড় সহজ কাজ নয়। তবু এভাবেই কয়েকমাসের মধ্যে একটা ভাড়াবাড়ির ব্যবস্থা করলেন।
মসলাবিক্রি থেকে ইনসিওরেন্স এজেন্ট নানারকম জীবিকা তখন।
খিদের বিরুদ্ধে অসহায় লড়াই।
অ্যানির কথায়, "অনেকদিন চোখের সামনে দেখতাম ছেলেটা খিদেতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। দেখা ছাড়া উপায় ছিল না।"

AnnieShiva2

চ্যালেঞ্জ অনেক। একা ছেলে নিয়ে থাকা। চারপাশে গুঞ্জন। অস্থির করা মন্তব্য। ভাত আর ছাদের একা লড়াই। ঘরে-বাইরে বিপদ।
আসলে কঠিন পরিস্থিতিগুলোই ভিতর ভিতর তৈরি করে দিচ্ছিল অ্যানিকে। লম্বা চুল ছিল। একদিন সব চুল কেটে ফেললেন। অসম্ভব হাল্কা লেগেছিল সেদিন।
পরিস্থিতি একটু আয়ত্বে এলে কাঞ্জিরমকুলম ছেড়ে চলে গেলেন অন্য জায়গায়। ভারকালায়। লেবুজল আর আইসক্রিম বিক্রি শুরু করলেন।
এক আত্মীয় পরামর্শ দিল পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় বসতে।
অ্যানির বাবা চাইতেন মেয়ে আইপিএস হোক। সেই ইচ্ছেটাই যেন ফিরে এল আবার। সব ছেড়ে দিলেন। এবার শুধু পড়া আর প্রস্তুতি।
দিনে ২০ ঘন্টা করে পড়তেন। কোচিং। ক্র্যাশ কোর্স। আর জীবন চালাবার লড়াই। এতটুকু ফাঁক নেই।
২০১৪-এ প্রথমবার কনস্টেবল পদের পরীক্ষাতে বসা। ২০১৬-তে সফল।
কিন্তু সেই সাফল্যে আটকে তিনি থাকেননি। স্বপ্নটা যে আরও বড়।
২০১৯-এ ফের পরীক্ষায় বসলেন। এবারও সফল।
যে এলাকায় একদিন লেবুজল বিক্রি করতেন সেখানেই ফিরে এলেন সাব-ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে।
অ্যানি বলেন, "জীবন আমায় যতবার হারাতে চেয়েছে ততবার আমি দশগুণ বেশি শক্তিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এই সাফল্য হয়ত খুব সামান্য, কিন্তু আমার ছেলেকে একটা স্বাভাবিক জীবন দিতে পারব। এতেই আমি খুশি..."

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...