বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা চাঁপাগঞ্জ। এই জেলার নাচোল উপজেলায় একটি গ্রাম তিকাইল গঞ্জ। সারা বিশ্বের শিল্প পিপাসুদের কাছে তীব্র আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের এক প্রান্তে ছোট্ট এই গ্রামটি।
পুকুর, আম- লিচুর বাগান, ছড়ানো ধান ক্ষেত, মেঠো রাস্তা আর তাল সারির এই গ্রামটি সাধারণ চোখে দেখতে গেলে সেরকম কোনও বিশেষত্ব চোখে পড়ে না। গ্রাম বাংলার আর পাঁচটা গ্রামের মতোই।
তবু টিকাইল গ্রাম মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে। এই গ্রাম তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের জন্মভূমি। এখনও এই গ্রামের মানুষ মনে রেখেছে আগুনে কন্যাকে। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি ‘রানীমা’।
টিকাইল গ্রাম শিল্পের গ্রাম। মাঠ-পথ পার হয়ে গ্রামের অন্দরে ঢুকলে চোখ আটকে যায় মাটির কাঁচা বাড়ির দিকে। বাড়ি নয় আসলে ক্যানভাস। রঙে রেখায় তারা যেন নিজেরাই নিজেদের গল্প বলে যাচ্ছে আপন খেয়ালে। প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল রঙিন করে তোলা হয়েছে রঙ এর ছবিতে। টিকাইল গ্রাম এই কারণেই আলাদা।
মাটির বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি, আলপনা এঁকেছেন গ্রামের নারীরা। নিজেরাই। কোনও রকম প্রথাগত তালিম নেই তাঁদের। ছবি আঁকা প্রথা। বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে। হিন্দু প্রধান গ্রাম। প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে আঁকা ছবির প্যাটার্ন, মোটিফ অন্যটির থেকে আলাদা। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। সহজ রেখার ছন্দে দেওয়াল, দাওয়া, উঠোন, ঘর সেজে উঠেছে লতা পাতা, পশু পাখিতে। জীবন যাত্রা আর নিজেদের জীবনের সুখ দুঃখের ছবি।
প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করার হয় ছবিতে। সেই রঙ শিল্পীরা নিজেরাই তৈরি করেন। শুকনো মাটি, আম আঁটির শাঁস চূর্ণ, চকগুঁড়া, মানকচু ও কলাগাছের কস বিভিন্ন রঙের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন কালারের রঙ। যে রঙে আঁকা আলপনা, সারা বছর শোভা পায় মাটির দেওয়ালে দেওয়ালে।
কোনও বিশেষ পালা পার্বন নয়, সারা বছরই আলপনায় সেজে থাকে বাড়ি ঘর। সেই কারণে এই গ্রামের পরিচিতি ‘আলপনা গ্রাম’ হিসেবে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে পর্যটকরা আসে এখানে। বাংলাদেশ সরকারও টিকাইল গ্রামকে বিশেষ স্বীকৃতি দিয়েছে।
তবে সম্মান স্বীকৃতি নয়, গ্রামের মহিলারা দেওয়াল রাঙান নিজেদের প্রাণের টানে। শিরায় ধারণ করে থাকা স্বাভাবিক শিল্পবোধ আর ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ে। এক সময় এই গ্রামে বিয়ের পাত্রী চূড়ান্ত করা হত তার হাতের আলপনার টানের সূক্ষতা দেখে। এখন সে প্রথা লুপ্ত হয়ে গেলেও শিকড়ের টান হারায় নি। যুগের পর যুগ ধরে এভাবেই বয়ে চলেছে বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ধারা।