নারীর গ্রাম, গ্রামের নারী

প্রায় পাঁচশো বছর আগের এক গ্রামীণ সভ্যতা। কেনিয়া পর্বত মাথা নামিয়ে মিশে গিয়েছে নায়েরি মরুভূমিতে। প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এবং বেড়ে ওঠা নিবিড় এক গ্রাম। সামবুরু উপজাতি ।অন্য সকল সভ্যতার সঙ্গে বৈপরীত্যে না গিয়ে এই উপজাতিও নারীদের করে রেখেছিল অবহেলিত।সূর্য ওঠে রোজ। আর রোজ অবহেলিত হন এই গ্রামের নারীরা। অবহেলাই যেন তাদের একমাত্র পাওয়া।

নারী সেখানে শুধু দ্বিতীয় শ্রেণীই নয় বরং কোণঠাসা তাদের সমস্ত অধিকারসহ। মেয়েবেলাতেই যৌনাঙ্গ কর্তনের মতো পাশবিক রীতির শিকার তারা।বয়সে বেশি পুরুষের সঙ্গে বিবাহে বাধ্য এরা। যত শতক গড়িয়েছে সভ্যতার, ততই নিষ্ঠুর হয়েছে পুরুষ শাসিত সমাজ।বেড়েছে নারী মৃত্যুর হার। নারী যেন পুরুষের ব্যক্তিগত মালিকানা।অনেকদিন উত্তপ্ত গ্রীষ্মের পর প্রকৃতির মন ভেজাতে, তাঁর মাটিতে জলের নাম নতুন করে লিখে যেতে ধেয়ে আসে হঠাৎ এক ভীষণ ঝড়।

ab1

সেই ঝড়ে অনেকদিনের পিঠ পোড়া রোদও পাত্তাড়ি গুটিয়ে গা ঢাকা দেয়। ঠিক তেমনটাই ঘটলো এখানেও। বছর তিরিশ আগে।রেবেকা লোলোসলি হল সেই না আঁচ করতে পারা ঝড়ের নাম। নেতৃত্ব দিলেন স্বাধীন অধিকার প্রতিষ্ঠার। নারী চালিত ও শাসিত একটা ছোট্টো গ্রাম এঁকে নিল নিজেদের নাম এই পৃথিবীর মানচিত্রে। ঊমোজা যার নাম।আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী যে রূপ দেখা যায়, ঠিক তেমন রঙিন বৈচিত্র্যে ভরপুর। সোয়াহিলি ভাষায় উমোজা মানে ঐক্য ।ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন ও বিভিন্নভাবে অবহেলিত ও নির্যাতিত ১৫ জন নারী নিয়ে একজোট হয়ে গড়ে ওঠে উমোজা। লোলোসলি স্বামী ও বিভিন্ন পুরুষের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন বহুদিন। চেষ্টা করেছেন বিচার চাওয়ার।

কিন্তু দেখলেন সেই নির্যাতনকারীরাই ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধে। তাই জেদ থেকেই নারীর এই অভয়ারণ্য গড়ে তোলা।যেখানে শুধু হবে নির্যাতিত নারী ও তার সন্তানদের নিরাপদ আবাস। পুরুষের বসবাস নিষিদ্ধ সেখানে। তার মানে এই নয় যে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ সেখানে।কিছু আদিবাসী নারীদের গড়ে তোলা আজব এক গাঁ। পৃথিবীব্যাপী নারী মহলের কাছেই এ এক দিবাস্বপ্ন। তাই ফি বছরে পা এর পর পা এসে ভিড়ছে এই গ্রামে।

ab2

কেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানে অতিথিদের বরণ করে নেয় এই সংগ্রামী নারীরা।প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হতে হয় তাদের রঙিন, ঝলমলে পোশাক আর গয়নায়।সেই মুগ্ধতাকে পুঁজি করেই চলছে বেঁচে থাকা। সেখানে নারীদের হাতেই তাদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্কুল,জাদুঘর। ইউএসএইডের সাহায্যে নির্মিত উমোজা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আর জাদুঘরে নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যাবে উমোজা’র আজকের অবস্থানে উঠে আসার আখ্যান।

ঐতিহ্যবাহী গয়না আর কাপড়কে পুঁজি করে সংগ্রাম চলছে নিরন্তর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনার।লড়াই চলছে নিজেদের জন্য পৃথিবী গড়ে তোলার ।রঙিন শৈলীর গয়না তুলে ধরেছে আফ্রিকান চেনা ঐতিহ্যকে।আসলে প্রতিটি গয়নায় আলাদা অলঙ্কার হিসাবে জড়িয়ে আছে উমোজা নারীদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প।শিশুর আজকের শিক্ষাই তাকে আগামীর যথার্থ পুরুষ করে গড়ে তুলবে। উমোজার স্কুলের শিক্ষাদানের ছবিটিও একই ইঙ্গিত দেয়।

সেখানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যাতে তারা ভবিষ্যতে অহিংস আর নারীর প্রতি নির্যাতনবিহীন একটি সমাজ তৈরি করতে পারে।উমোজা’তে পুরুষের বাস নিষিদ্ধ হলেও গ্রাম থেকে কিছু দূরে এই নারীদের উদ্যোগেই নদীর পাশে ক্যাম্পসাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উমোজাতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারে সেখানে প্রাণ খুলে। সামান্য টাকায় উমোজাতে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কেনা গয়না ও নারীদের বানানো বিভিন্ন হস্ত শিল্প কেনার টাকাই জীবনধারনের চাবিকাঠি।২০০৪ অথবা ২০০৫ এর গোড়ায় উমোজার নারীরা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে শুরু করে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনুপ্রেরণার খোঁজে ছুটে আসেন লোকজন।

এছাড়া সঙ্গত দিয়েছে ইউনিসেফও। তবে এতকিছুর পরও আফ্রিকার পুরুষ সমাজের বিভিন্ন অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করে চলেছে তারা।এখনও পুরুষশাসিত সমাজ সঠিকভাবে নিতে পারেনি নারীদের পরিচালনা। তবুও এগিয়ে চলছে তারা। মনে করেন পুরুষরাই একমাত্র বাঁধা।

আর কোনও কিছুকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের সামর্থ্য দিয়েই আয় করে নিচ্ছেন জীবনযাপনের সবকিছু।কোনও মহিলা চাইলে সে গ্রামের পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে পছন্দের পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেই পারে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে না ফিরে এলে থেকে যেতে হবে বাইরেই। ছেলে শিশুদের আঠারো পেরলেই তাদেরও চলে যেতে হয় উমোজা ছেড়ে।

প্রায় পঞ্চাশ নারী ও ২০০ শিশুর নিরাপদ আবাসস্থল উমোজা এখন ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের দারুণ এক গন্তব্য।
শুধু ভ্রমণ অভিজ্ঞতাই নয়, সেখানে মিলতে পারে জীবনের অন্য মানে। নারীবাদের অন্য সংজ্ঞা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...