মননে-মেজাজে উৎপল দত্ত

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উৎপল দত্ত। মানুষটা নাট্যকার হিসেবে, শিল্পী হিসেবে অসম্ভব রকমের গোছানো; পরিচালক হিসেবে সৃষ্টিসুখে অস্থির আর ভীষণ ভীষণ কড়া। শিশুদের তিনি 'বাইডু' বলে সম্বোধন করতেন। চটিতং মেজাজের জন্য কিছুতেই শিশুশিল্পীদের হ্যান্ডেল করতে পারতেন না। জলদগম্ভীর স্বর আর তিরিক্ষে মেজাজের সামনে পড়ে তাদের কাপড়চোপড় হলুদ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে। ফলত, তাঁর লেখা নাটকে শিশুচরিত্রের সমারোহ প্রায় নেই বললেই চলে।  শিশু তো কোন ছার, পরিচালক উৎপল দত্তের সামনে দাঁড়াতে বড়দেরও থরহরিকম্প অবস্থা হতো। এদিক থেকে তিনি গিরিশযুগের নাট্যপরিচালকদের মতোই কড়া শিক্ষক ও স্রষ্টা। 

নাট্যপরিচালক উৎপল দত্ত কেমন করে নাট্যপরিচালনা করতেন? 'জাতীয় সাহিত্য পরিষদ'-প্রকাশনীর কর্ণধার ও নাট্যরসিক সুনীল দাসের একটি লেখায় তার পরিচয় পাই। 

ভারতীয় গণনাট্য সংঘ সে-বার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিসর্জন' নাটকটি মঞ্চস্থ করবে। 'সে-বার' মানে, পাঁচের দশকের কথা বলছি। সে-সময় কলকাতার সংগঠনের দায়িত্বে উৎপল দত্ত। বহুচর্চিত এই নাটকটা সবারই পড়া।  তবু, উৎপল দত্ত চরিত্র ভাগাভাগি করে সবার হাতে একটা করে নাটকের কপি ধরিয়ে দিলেন। বললেন, রিহার্সালের দিন নিজের নিজের পাঠ ঝাড়া মুখস্থ করে আসতে। রিহার্সাল হবে ছেচল্লিশ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটে। সেটাই তখন একাধারে সিপিএমের পার্টি অফিস, গণনাট্যের মহলাকক্ষ, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আখড়া।  তা, সেখানকার ছোট্ট পরিসরে রিহার্সাল হবে কি করে, এত এত আর্টিস্ট? উৎপল স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জানালেন, সে ভাবনা তাঁর।

'বিসর্জন'-এর অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কালী ব্যানার্জি, ঋত্বিক ঘটক, উমানাথ ভট্টাচার্য, শোভা সেনের মতো শিল্পীরাও; যাঁরা পরবর্তীকালে নিজের নিজের ক্ষেত্রে স্বনামধন্য হয়েছেন।  তবে তাঁরাও সেদিন ওই 'এককথার লোক', 'সময়নিষ্ঠ' লোকটার কাছে একেবারে তটস্থ। হ্যাঁ, 'সময়নিষ্ঠ'। তিনি সত্যজিতের ফেলুদার মতোই পাঁচটা বলতে, পাঁচটাই বোঝেন। বাঁধা সময়ের একচুল এদিক ওদিক হলেই তিনি হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ দুর্বাসা মুনি। তাই রিহার্সালের দিন আপামর সবাই সময়ে এলেন, মুখস্থ করে এলেন। 

 সবাই যখন হাজির, তখন উৎপল একটিও কথা না-বলে তাঁদের সামনে দাবার ছক পেতে ঘুঁটি সাজিয়ে বসলেন। সবাই অবাক, এ দিয়ে হবেটা কি! এখন রিহার্সালের সময় খেলা হবে নাকি? নাহ। একটু পরই সবার ভুল ভাঙল। তাঁরা বুঝতে পারলেন, দাবার ছকটা আসলে উৎপলের মঞ্চ আর ঘুঁটিগুলো এক একটি চরিত্র। সে এক দেখার মতো জিনিস, অভিনব এক পদ্ধতি! উৎপলের নির্দেশে অভিনেতারা নিজের নিজের সংলাপ মুখস্থ বলে যেতে লাগলেন আর উৎপল এক একটি ঘুঁটি চেলে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন কোন চরিত্র কোন দিক দিয়ে ঢুকবেন, কোথায় এসে দাঁড়াবেন, কতটা এগোবেন, কি করবেন–এভাবে পুরো কম্পোজিশন তৈরি হয়ে গেল। ছোট্ট অপরিসর জায়গায় উদ্ভাবনী ক্ষমতায় এভাবেই নাটকের রিহার্সাল করিয়ে নিলেন উৎপল। আর এই দাবার ছকে ঘুঁটির চাল মাথায় রেখেই প্রতিটি অভিনেতাকে মঞ্চে নামতে হল। মাথায় না রেখে কারও উপায় নেই, একটু এদিক ওদিক হবার জো নেই; মেজাজী মানুষ উৎপল বকুনির চোটে একেবারে ভুত ভাগিয়ে ছাড়বেন যে! তবে এর মধ্য দিয়ে যখন তা মঞ্চস্থ হল, তখন ‘বিসর্জন’ হয়ে উঠল যেন 'সুপরিকল্পিত সুসংহত এক চলচ্চিত্র'! সে এক অপূর্ব প্রযোজনা! যাকে বলে, কালজয়ী। আর এই সুপরিকল্পিত প্রযোজনা সম্ভব হয়েছিল উৎপল দত্তের অভিনব উদ্ভাবনী ক্ষমতা, কড়া এবং খুঁতখুঁতে সাহেবি মেজাজের জন্যই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...