ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব জন্মেছিলেন সেকালের হিন্দুস্তান, বর্তমানের পাক-পাঞ্জাবের অন্তর্গত কাসুর গ্রামে। তাঁর পূর্বপুরুষ ফৈয়াজ পিরদাদ খাঁ সাহেব গজনি থেকে এখানে এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন। এটাই ছিল তাঁর সিদ্ধিস্থল। এখানে আসার ব্যাপারটা ঘটেছিল খানিকটা এরকমভাবে : ফৈয়াজ পিরদাদ ছিলেন সঙ্গীতের জন্য, একেবারে 'দিওয়ানা'। ফকিরের বেশে লোকালয় ছেড়ে নির্জন পাহাড়ের চূড়ায়-কন্দরে সঙ্গীতের সাধনা করতে করতে যে-দিকে দু'চোখ যায়, চলতে শুরু করলেন। এমনি করে পায়ে পায়ে একদিন তিনি হাজির হলেন পাঞ্জাবের এক নির্জন প্রদেশে, কাসুরার উপকণ্ঠে। সেখানেই একদিন সঙ্গীতের দেবী যেন তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। বললেন, 'ফৈয়াজ পিরদাদ! তুমি সঙ্গীতসাধনায় সিদ্ধ হয়েছ; এই সিদ্ধির ধারা চিরকাল বয়ে যাবে তোমার বংশধারার সঙ্গে।' এরকম একটা স্বপ্ন দেখে ফৈয়াজ পিরদাদের আনন্দের অন্ত রইল না, তখনই ঠিক করলেন এই সিদ্ধিস্থানেই বসত গড়বেন।
দেবীর কথাটা স্বপ্নই হোক বা নিছক গল্প; পরম্পরায় এ-বংশের সবাই কিন্তু রাগ-সঙ্গীতে ওস্তাদ। পিরদাদের পুত্র ইরসাদ আলি খাঁ সাহেব তো সবাইকে টেক্কা দিয়ে নতুন এক সঙ্গীত ঘরানাই সৃষ্টি করে ফেললেন। নিজের গ্রামের নামে সে ঘরানার নাম দিলেন, 'কাসুর ঘরানা'। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র মোহাম্মদ ইছা খাঁ সাহেব এই ঘরানার ঐতিহ্য নিয়ে পাতিয়ালার সভাগায়ক হলেন। কিন্তু অল্প বয়সে তাঁরও মৃত্যু হল, রেখে গেলেন দুই কিশোরপুত্র আলি বক্স এবং কালে খাঁ-কে। আর দিয়ে গেলেন নিজস্ব ঘরানার ঐতিহ্য। তখন এই দুই ভাইয়ের তালিমের ভার নিলেন পাতিয়ালার আর এক সভাগায়ক ওস্তাদ ফতেহ আলি খাঁ সাহেব। তাঁর ঘরানা, 'পাতিয়ালা ঘরানা'। তাঁর কাছে তালিম নিয়ে ওস্তাদ আলি বক্স খাঁ সাহেব ও ওস্তাদ কালে খাঁ সাহেব দুই ঘরানার মধ্যে সৌন্দর্য-সূত্রের মেলবন্ধন ঘটালেন, তৈরি হল, 'কাসুর-পাতিয়ালা ঘরানা'।
'কাসুর-পাতিয়ালা ঘরানা'-র নব্যরীতিতে সাত বছর বয়সী ছোট্ট গোলাম আলির তালিম শুরু হল। তালিম দিতে লাগলেন কাকা ওস্তাদ কালে খাঁ সাহেব। শিশু যেভাবে মায়ের মুখ থেকে মায়ের ভাষা শেখে, সেভাবেই তাঁর কাছে সরগম শিখলেন তিনি। কাকা তাঁকে একদিন নিয়ে গেলেন স্থানীয় মসজিদে। সেখানে গিয়ে এক নির্জন দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন দু'জনে। তারপর কাকা তাঁকে গাইতে বললেন। গোলাম গাইলেন। কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে লাগল তাঁর কানে। ফলে, নিজেই ধরতে পারলেন কোথায় কোথায় স্বরে-সুরে ত্রুটি হচ্ছে। এরপর থেকে মসজিদের এই অংশটি গোলামের কাছে রেওয়াজের প্রিয় স্থান হয়ে উঠল। এভাবে চলল দশটা বছর। এরই পাশাপাশি তাঁর সারেঙ্গি-শিক্ষাও চলতে লাগলো। এটা তাঁর প্রাণের জিনিস। মনে মনে ইচ্ছে, এটা নিয়েই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবার। পরিবারে সবাই তো কণ্ঠ নিয়েই আছেন, তিনি এই বংশে নতুন কিছু করে দেখিয়ে দেবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর-এক!
গোলামের যখন বছর কুড়ি বয়স, তখন বাবা আবার বিয়ে করলেন। সৎমা আর তার আত্মীয়স্বজনেরা প্রত্যেকেই বজ্জাতের একশেষ। গোলামকে বাড়ি থেকে তাড়াতে তারা উঠে পড়ে লাগল। ছেলের বিরুদ্ধে বাবার কানে বিষ ঢোকাতে লাগল। গোলাম বিরক্ত হয়ে সাধের সারেঙ্গিটি নিয়ে বাড়ি ছাড়লেন। গেলেন বম্বে। ভাবলেন, সারেঙ্গি বাজিয়ে খাবেন। কিন্তু, অনেক ঘোরাঘুরি হল, কাজের কাজ তেমন হল না। কপাল ভালো, ইতিমধ্যে বাবা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। এবং ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। এসবের মধ্যেই একদিন হঠাৎ মারা গেলেন কাকা। সবাই আফসোস করতে লাগলো এই বলে যে, কালে খানের মৃত্যুতে ঘরানাটাই বুঝি শেষ হয়ে গেল! তখন অদ্ভুতভাবে গোলামের মনে ঘরানা বাঁচিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভূতপূর্ব এক জেদ চাপল। দিন-রাত এক করে দিলেন পাঁচ পাঁচটা বছর। তালিম নিলেন আশাক আলি সাহেবের কাছে। খেয়াল গায়কীতে দুর্দান্ত হয়ে উঠলেন। পাশাপাশি, ঠুংরি আর লোকগানের প্রতিও তৈরি হল তাঁর দুর্মর আগ্রহ। ইতিমধ্যে নানান আসরে গাইতেও শুরু করলেন। কিন্তু, খ্যাতি তেমন এলো না।
অবশেষে এলো ১৯৪৪ সাল। বম্বের 'বিক্রম মিউজিক কনফারেন্স'-এ 'মারওয়া' আর 'পুরিয়া' পরপর গেয়ে অসাধ্যসাধন করে দেখালেন। আর তারপরই যখন পাঞ্জাবি রীতিতে 'পাহাড়ি' শোনালেন, তখন শ্রোতারা একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ। সেদিন সঙ্গীত-রসিকদের তিনি গায়কী দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, তাঁর কাছে স্বরের বিশুদ্ধতার ওপরে আর কিছুই নেই। প্রয়োজনে তিনি ঘরানা, তান, নোটেশন, আলাপের ঐতিহ্যকে ওলটপালট করে দিতে পারেন। নতুন কিছু করে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে নিজের কাছেই পরখ করে নেওয়ার খেলায় তিনি ওস্তাদ। আর এই খেলায় তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠ অন্য এক মায়ালোক সৃষ্টি করে। বলতে গেলে, এখান থেকেই শুরু হল তাঁর খ্যাতির জয়যাত্রা।
সুরস্রষ্টা হিসেবে গোলাম 'সবরঙ' ছদ্মনামে অনেক সুর সৃষ্টি করেছিলেন। এবার যে সময়ের কথা বলছি, তখন দেশ ভাগ হয়ে গেছে। বড়ে গোলাম খাঁ সাহেব এদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সেইসঙ্গে তাঁর গায়কীতে পুরোপুরি 'পাতিয়ালা ঘরানা'-র রীতিকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে এই ঘরানাকে তিনি যেমন প্রকৃত অর্থে জনপ্রিয় করে তুলছেন, তেমনি জগতের সঙ্গীত-রসিকমহলেও খ্যাতনামা হয়ে উঠেছেন। এই সময় একদিন তাঁর বোম্বের বাড়ি থেকে আর পাঁচটা দিনের মতোই হাঁটতে বেরোলেন বন্ধু বি আর দেওধরের সঙ্গে। হাঁটতে হাঁটতে ভাঁজছেন প্রিয় রাগ 'মারওয়া'। এমন সময় হঠাৎ পথে চোখ টানল অতীব সুন্দরী এক পাঞ্জাবি যুবতী। আহা, তার রূপের প্রশংসায় গোলাম সাহেব একেবারে পঞ্চমুখ, মুগ্ধতা যেন কিছুতে শেষ হয়না। আর সেই আবেগেই তক্ষুনি রচনা করে ফেললেন অপূর্ব একখানা ঠুংরি। এ যেন, আমাদের পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ও কেন এত সুন্দরী হল' গানটির সৃষ্টি-কথাকে মনে করিয়ে দেয়।
খ্যাতনামা এই সদা সৃষ্টিময় মানুষটির সঙ্গীতজীবন কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন শেষ হয়ে গেল! সে যেন এক দুর্ঘটনা। ১৯৬১ সালের মে মাসে তাঁর স্ট্রোক হল। প্যারালাইজড হয়ে গেলেন। গান চলে গেল জীবন থেকে। ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষটি প্রতিদিন প্রার্থনা জানিয়ে গেলেন, তাঁর ভালোবাসার জীবন, গানের জীবনটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। না, সে সৌভাগ্য আর হয়নি। আরও সাত সাতটা বছর ধরে চলল তাঁর স্বর-হারানোর যন্ত্রণা। যার অবসান হল ২৩ এপ্রিল, ১৯৬৮ সালে।
তথ্য ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
পণ্ডিত অনিন্দ্য ব্যানার্জি
ড. সুগত মার্জিত
USTAD BADE GHULAM ALI KHAN: LIFE, GAYAKI AND RECORDS --LECTURE NOTES BY PROF. S R MEHTA
PILLARS OF HINDUSTANI MUSIC BY B R DEODHAR