নিষ্ঠা, ভালোবাসা আর সংগ্রামের আর এক নাম, অভয় মিত্র। জাগলিং তাঁর জীবন। হুগলির কুমীরমোড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা কালোসোনা মিত্র। জিপসীদের প্রাচীন কলা জাগলিং-এর প্রতি কালোসোনার ছিল অদম্য ভালোবাসা। ছিল চর্চা। সেই ভালোবাসার উত্তরাধিকার নিয়েই জন্ম নিলেন পুত্র অভয় মিত্র। খুব ছোটবেলাতেই বাবার কাছে হল তাঁর জাগলিং-এ হাতেখড়ি। কিন্তু কপাল এমন, বেশিদিন বাবার সাহচর্য পাবার সৌভাগ্য হল না। দশের কোঠা পেরোবার আগেই হঠাৎ বাবাকে হারালেন। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সংসারটা টানার মতো কেউ রইলো না। অভাব এসে চারপাশ থেকে চেপে ধরল!
মায়ের গয়নাগাটি যেটুকু ছিল, গেল। আসবাবপত্র যা ছিল, তাও গেল। তবু কিছুতেই সামাল দেওয়া গেল না। তখন স্কুল ছেড়ে সে-বয়সেই সংসারের হাল ধরতে অভয় কাজের খোঁজে পথে নামলেন। খুঁজতে খুঁজতে কাজ পেলেন এক কারখানায়। হপ্তার সাতদিনই হাড়ভাঙা খাটুনি। তার ওপর একটু বেশি রোজগারের আশায় ওভার টাইম। শুরু হল পুরোদস্তুর শিশুশ্রমিকের জীবন। জীবন থেকে তো সবই গেল, কিছুই তো রইলো না; তবু তারই মাঝে আঁকড়ে রাখলেন তাঁর প্রাণ, তাঁর সাধনা 'জাগলিং'। খাওয়া বা টিফিনের অবসরে কিম্বা কাজের শেষে যেটুকু সময় পান, তখনই শুরু হয় তাঁর জাগলিং-এর প্র্যাকটিস।
কাজের শেষে একদিন প্র্যাকটিস করছিলেন অভয়। তখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন কারখানার মালিক বীরেনবাবু। ছেলেটির দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখলেন ছেলেটির হাতের কাজ। অভয়ের এই কঠোর অধ্যবসায় দেখে তাঁর খুব ভালো লাগল। বাহ, গুণী ছেলে তো! ছেলেটির উপর কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেল তাঁর। নাম জানলেন, অভয়। বীরেনবাবু যেন আশীর্বাদের মতোই এলেন অভয়ের জীবনে। তাঁকে পরদিন থেকে কম পরিশ্রমের কাজ তো দিলেনই, সেইসঙ্গে জাগলিং-এ উৎসাহ দিতে লাগলেন, রাত্রের স্কুলে পড়ার ব্যবস্থাও করে দিলেন। এই মানুষটির সাহচর্যেই একদিন কমার্সে গ্রাজুয়েট হয়ে উঠলেন অভয়। চাকরি পেলেন ব্যাঙ্কে। তারপর উত্তরপাড়ায় বাড়ি হল। সংসার হল। সন্তান হল। আর জীবনের এই বিবর্তনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে রইল, জাগলিং।
আপাত আর্থিক সুনিশ্চয়তা যেই এলো জীবনে, অমনি জাগলিং-চর্চাকে বাঁচিয়ে রাখা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হয়ে উঠল অভয়ের একমাত্র সাধনা। শুরু করলেন কলকাতার এখানে-ওখানে শো করতে। চাইলেন, মানুষকে জাগলিং-এর প্রতি আগ্রহী করে তুলতে। এমনি করেই একদিন এলো ১৯৭৮ সাল।
বন্ধু জুনিয়র পি সি সরকার একদিন তাঁকে নিয়ে গেলেন চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কাছে। সত্যজিৎ 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-নামে একটা ছবি করবেন। তাতে একটা ড্যাগার থ্রোয়িং সিন আছে, সেজন্য একজন দক্ষ জাগলার চাই। সেই দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। সিনটা খুব রিস্কি, তাই সত্যজিৎ সবদিক দেখে, বুঝে, আঁটঘাট বেঁধে তবেই নামবেন। গুরুত্ব বুঝে অভয় পরীক্ষা দিতে রাজি হয়ে গেলেন। পরদিন ঘন্টাখানেক ধরে ড্যাগার থ্রোয়িং, বল এন্ড স্টিক এন্ড হ্যামার জাগলিং, রিবন ডান্সিং, সোর্ড ব্যালান্সিং, হ্যাট থ্রোয়িং প্রভৃতি দেখালেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। সত্যজিৎ দারুণ খুশি হলেন, পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, 'ওয়েল ডান'!
ব্যস, এভাবেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর সাহচর্যের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেল। 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-ছবিতে জটায়ু-সন্তোষ দত্তের দিকে ড্যাগার ছোঁড়ার দৃশ্যে ব্যাক টু ক্যামেরায় অর্জুন-কামু মুখার্জির ডামি হয়ে অভিনয় করলেন অভয়। অব্যর্থ ও নিরাপদ লক্ষ্যে ড্যাগার দিয়ে বিদ্ধ করলেন জটায়ুর তিন-পাশ। আর এ-কথাটা প্রচার পেতেই কলকাতায় তো বটেই, দেশের নানান প্রান্তে তাঁর বেশ নাম হল। মানুষ তাঁর সম্পর্কে আরও আগ্রহী হল। এরপর তিনি ১৯৮৩-তে সন্দীপ রায়ের ছবি 'ফটিকচাঁদ' এবং ১৯৯১-এ 'গুপী বাঘা ফিরে এলো'-তেও তাঁর বিখ্যাত জাগলিং দিয়ে জগৎ মাতালেন।
ছবির সূত্রে ও কলানৈপুণ্যের সূত্রে দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়ল অভয় মিত্রের নাম। বিদেশ থেকে আসতে লাগল আমন্ত্রণ। ১৯৯১ সালে তিনি আমন্ত্রিত হলেন ফ্রান্সে। টানা একুশখানা শো করলেন। তারপর গেলেন নিউজিল্যান্ড। শো করলেন তেইশখানা। তাঁর স্বপ্ন ছিল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবেন তাঁর জাগলিং, এভাবেই শুরু হল সেই স্বপ্নপথের যাত্রা। পেতে লাগলেন দেশ-বিদেশের সংবর্ধনা। সংবর্ধনার পালা অবশ্য শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকেই। ১৯৮৪ সালে। সেবার তাঁকে দেওয়া হয়, 'সিনিয়ার পি সি সরকার ট্রফি'; আর খেতাব দেওয়া হয়, 'দ্য গ্রেটেস্ট জাগলার অব ইন্ডিয়া'।
অভয় মিত্র তাঁর ষাট বছরের জাগলিং-জীবনে দেশে-বিদেশে দশহাজারের বেশি শো করেছেন। দুরদর্শনের বিভিন্ন প্রাদেশিক চ্যানেলে শো করেছেন। নিজের উদ্যোগে জাগলিং একাডেমি গড়ে তুলেছেন। তৈরি করেছেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে। আর নিজের পরিবারে ছড়িয়ে দিয়েছেন জাগলিং-এর উত্তরাধিকার।
গত এগারো এপ্রিল এদেশের জাগলিং-এর কান্ডারি অভয় মিত্র চলে গেলেন; রেখে গেলেন জাগলিং-এর ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পথ।