সারদা তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেবার ভার নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে, থাকেন ছোট্ট এক চিলতে ঘর 'নহবত'-এ। সেখানেই তাঁর খাওয়া-শোয়া, সেখানেই তাঁর রাঁধাবাড়া। মন্দিরের চকমিলানে ঠাকুরের ঘর। ঠাকুর ডাকলে তবেই সেখানে তাঁর যাবার উপায় হয়, নইলে নয়। ফলে, ঠাকুরের পছন্দের পদাবলি রান্নাবান্নার পর তাঁর অবসরের অভাব হবার কথা ছিল না। কিন্তু, অভাব ছিল। কারণ, প্রিয় ভক্তদের সারাদিন আনাগোনা লেগেই থাকত মন্দির ও ঠাকুরের ঘরে। তাঁদের জন্য ঠাকুরের আবদারে খাবার-জলখাবার বানাতে বানাতে সারদার সারাটি দিন কেটে যেত, কেটে যেত সারাটি সন্ধ্যে এবং রাত্রির এক-দেড় প্রহর।
তবুও একদিন তারই মাঝে একটুখানি অবসর হল তাঁর। অনেকদিনের সাধ নিজের হাতের গাঁথা মালা পরাবেন ভবতারিণীর গলায়। তাই এই সুযোগে সংলগ্ন উদ্যান থেকে তুলে আনলেন সাজি ভরে জুঁই আর রঙ্গন। তারপর সযতনে সারা হল তাঁর মালা গাঁথা। ভারি সুন্দর হল মালাটি। নিজের তো আর যাবার উপায় নেই। তাই বৃন্দা ঝি-কে দিয়ে সেটি ঠাকুরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন আর বলে পাঠালেন তাঁর বাসনার কথা।
মালাখানি পেয়ে আর সারদার বাসনার কথা জেনে ভারি তুষ্ট হলেন ঠাকুর। শ্যামামায়ের গলায় সেই মালা পরিয়ে দিয়ে বৃন্দা ঝিকে দিয়ে বলে পাঠালেন, 'মালাখানি যে গেঁথেছে তাকে একবার ডেকে নিয়ে আয় দিকি বৃন্দে, দেখে যাক মাকে কেমন দেখাচ্ছে!'
ঠাকুরের ডাকে মন্দিরে এলেন সারদা। মন্দিরে এসে তাঁর এক অদ্ভুত দর্শন হল। তিনি দেখলেন, শ্যামা মায়ের মুখের ওপর অবিকল ঠাকুরের মুখ আঁকা! গলায় সেই সদ্য গাঁথা মালা! অমনি তাঁর এক আশ্চর্য উপলব্ধি হল, ঠাকুর আর মায়েতে তো কোন ভেদ নেই! মায়ের মধ্যেই ঠাকুর, ঠাকুরের মধ্যেও মা!
তারপর গঙ্গার স্রোত বেয়ে কত কত দিন চলে গেল। ঠাকুর তখন শেষ শয্যায়। গলার ভেতরের ঘা বাইরেও দেখা দিয়েছে। সে বড় নিদারুণ কষ্ট। ঠাকুরের কষ্ট দেখে সারদা আর থাকতে পারলেন না। তাঁকে সারিয়ে তোলার আকুতি নিয়ে তারকেশ্বরে গিয়ে হত্যে দিলেন তারকনাথের চরণে। কিন্তু, তারকনাথ ফিরিয়ে দিলেন তাঁকে। এক জ্যোতির্ময় পুরুষের বেশে তাঁকে বলে গেলেন, মানুষ হয়ে জন্মালে মরতে তো হবেই! আর সেই মৃত্যুরও তো একটা ছুতো চাই, লোকে যাকে বলে 'হেতু'। এই রোগটাই সেই 'হেতু'।
সারদা ফিরে এলেন খালি হাতে। উতলা মন তবু মানতে চাইল না। গেলেন প্রাণের দেবী ভবতারিণীর কাছে। পরম ভক্তের জন্য রোগমুক্তির প্রার্থনা করতে। কিন্তু, এবারেও তাঁর এক আশ্চর্য দর্শন হল। দেখলেন, মা ভবতারিণীর গলাতেও ফুটে উঠেছে ঠাকুরের গলার ঘা! মা যেন সারদাকে আর একবার জলের মতো সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন যে, ভক্ত ও ভগবান আসলে অভিন্ন সত্তা, ভক্তের কষ্টই ভগবান ভোগ করেন। যিনিই রামকৃষ্ণ, তিনিই ভবতারিণী শ্যামা। সারদা কার কাছে কার নিরাময় চাইবেন! এভাবে ভক্ত ও ইষ্টকে অভিন্ন উপলব্ধি করলেন বলেই ঠাকুর যখন দেহ রাখলেন, তখন শ্যামা মায়ের পায়ের তলায় সারদা লুটিয়ে কেঁদে উঠলেন-'মা কালী গো! তুমি এমন করে আমায় ফেলে কোথায় চলে গেলে গো!' বলে...
বিয়ের সময় সারদার বয়স ছিল ছয় আর গদাধরের (রামকৃষ্ণদেব) চব্বিশ। সারদা গরীবের মেয়ে, গরীবের বউ। তাই তাঁকে গয়না গড়িয়ে দিতে পারেননি শাশুড়ি চন্দ্রমণি। নতুন কুটুমের কাছে মান রাখতে প্রতিবেশী বড়লোক লাহা বাবুদের বাড়ি থেকে গয়না চেয়ে পরিয়ে বৌমাকে বরণ করেছিলেন। ছোট্ট সারদা ঘুমিয়ে পড়লে সেইসব গয়না নিজের হাতে খুলে গদাধর ফেরৎ দিয়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠে গায়ের গয়না দেখতে না-পেয়ে সারদা খুব কেঁদে ছিলেন। কিছুতেই তাঁকে ভোলানো যায় নি। সারদাকে দুঃখ দিয়ে তাই সেদিন গদাধরের খুব কষ্ট হয়েছিল। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে গদাধর যখন দক্ষিণেশ্বরে সকলের প্রানের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস হয়ে উঠলেন, তখনও তিনি ছোট্ট সারদার সেই কান্না ভুলতে পারলেন না। তাই পরবর্তীকালে সাধ করে সারদাকে তিনি একজোড়া সোনার বালা গড়িয়ে দিলেন।
বিধবার অঙ্গে সে-কালে সোনা রাখার বিধান ছিল না। তাই ঠাকুর দেহ রাখার পর বৈধব্যদশায় সারদা সেই বালাজোড়া খুলতে গেলেন; কিন্তু, তাঁর অত সাধের উপহার, শৈশবের বাসনার ধন সারদা খুলে ফেলবেন, এটা বিদেহী ঠাকুর সইতে পারলেন না। স্বয়ং অভির্ভুত হয়ে বাধা দিলেন। বললেন, 'ওগো, আমি কি কোথাও গিয়েছি? কোথাও তো যাইনি। শুধু এ-ঘর থেকে ও-ঘর হয়েছি মাত্র!' অমনি মুহূর্তেই মায়ের কাছে খুলে গেল এপার-ওপারের দরজা। বুঝলেন, মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায়নি, ঠাকুর এখনো সর্বত্র বিরাজ করছেন অদৃশ্য অ-রূপে অথচ অখণ্ড সত্তায়। আর তাঁর সেই অখণ্ড সত্তাকে সঙ্গী করেই ঠাকুরের লীলাসঙ্গিনী থেকে এরপর সারদা হয়ে উঠলেন আপামর সকলের মা, 'মা সারদা'; স্নেহ-প্রেম ও করুনাকে পাথেয় করে সহজ ইষ্টপথের সন্ধান দিয়ে হয়ে উঠলেন সর্বজনপূজ্য মা 'সারদেশ্বরী'।