দু'শো বছরের জন্মতিথিতে ভারতের প্রথম 'দেশীয় বিচারপতি' শম্ভুনাথ পণ্ডিত

ছেলে যখন দশম শ্রেণিতে পড়ছে, তখনই একদিন জোর করে বাবা তাঁর বিয়ে দিয়ে দিলেন। ছেলেকে পথে বসিয়ে অবিলম্বে কলেরায় মারাও গেলেন। এই পরিস্থিতিতে ছেলের পড়াশুনো মাথায় উঠল। ক্লাস টেনের বিদ্যে আর পৈতৃক উর্দু-ফার্সি-ইংরেজির জ্ঞানটুকু  নিয়ে  উকিলদের সেরেস্তায় আইনি কাগজ অনুবাদের কাজ নিলেন। সেইসঙ্গে শুরু করলেন আইন পড়া। অসাধারণ অধ্যবসায়ে শুধু যে সফল হলেন তাই নয়, সামান্য উকিল থেকে একদিন হয়ে উঠলেন ভারতের 'প্রথম দেশীয়' বিচারপতি। শম্ভুনাথ পণ্ডিতের জীবনটাই ছিল এরকম। তেতাল্লিশ বছর বয়সে বিচারপতি হয়ে যোগ দিয়েছিলেন কলিকাতা হাইকোর্টে। দিনটা ছিল, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৩ সাল। আর এর কয়েক বছর পরই 'সুরধুনী কাব্য' (১৮৭১ সাল)-গ্রন্থে দীনবন্ধু মিত্র সেই গৌরবের ক্ষণটিকে বিশেষিত করে ছন্দরূপ দিয়েছিলেন, যা থেকে বোঝা যায় বিচারক হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তিটি কেমন ছিল ---

"হাইকোর্ট বিচারের আসন নীরজ,

এ দেশের শম্ভুনাথ বসিয়াছে জজ,

সুদক্ষ বিচারে অতি, নিরীহ নিতান্ত,

গুণে যুধিষ্ঠির ধীর, রূপে রতিকান্ত।"

কাশ্মীরি হিন্দু মানেই, পণ্ডিত। শম্ভুনাথের ঠাকুরদা মনসারাম ছিলেন কয়েক পুরুষ ধরে কাশ্মীরের বাসিন্দা। আঠেরো শতকের শেষ নাগাদ ঘটল ভাগ্য বিপর্যয়। আফগান শাসকদের ভয়ে ও অত্যাচারে সেখান থেকে জ্ঞাতিদের সঙ্গে দুই ছেলে সদাশিব আর শিবপ্রসাদকে নিয়ে গোপনে পালাতে বাধ্য হলেন। নানান জায়গা ঘুরে শেষমেশ লক্ষ্মৌ শহরে এসে তাঁরা থিতু হলেন।  মনসারাম এখানে এসে ভালো করে ছেলেদের ফার্সি ও উর্দু শেখালেন। কিন্তু এ-বিদ্যায় কোন কাজ জুটল না লক্ষ্মৌ শহরে। সুতরাং, বেরুতে হল কাজের সন্ধানে। বড়ভাই সদাশিব এলেন মোকাম কলিকাতায়। আর শিবপ্রসাদ গেলেন বেনারস।  কলিকাতার আদালতে-সেরেস্তায় উর্দু-ফার্সি জানা লোকের তখন খুব চাহিদা। কাজেই সদর দেওয়ানি আদালতে কাজ জুটিয়ে নিতে খুব একটা অসুবিধে হল না। অবিলম্বে কলুটোলা স্ট্রিটে একখানা বাসা নিয়ে ফেললেন। এদিকে বেনারসে কাজের সুবিধে করতে না পেরে শিবপ্রসাদ এলেন দাদার কাছে। তাঁকেও এই দেওয়ানি আদালতে কাজ পাইয়ে দিলেন সদাশিব। ফলে, দুইভাই হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর কলিকাতাবাসী। এখানেই জন্ম হল শিবপ্রসাদের প্রথম সন্তান, শম্ভুনাথের। কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে, শম্ভুনাথের জন্ম নাকি হয়েছিল বেনারসে। কোনটা সঠিক, তার পেছনে নিশ্চিত প্রমাণ নেই।

শম্ভুনাথের জন্ম হয়েছিল ১৮২০ সালে, তারিখ জানা যায় না। এবছরই বাংলার আর এক দিকপাল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়েছিল। দুজনের প্রথমবার দেখা ও আলাপ হয়েছিল বেথুন স্কুলে।  ছাত্রীদের প্রথম পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। দুজনেই তখন নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিখ্যাত। এই অনুষ্ঠানে শম্ভুনাথ দিয়েছিলেন সোনার বালা আর বিদ্যাসাগর দিয়েছিলেন চিক। বলতে গেলে, এই সভা থেকেই দুজনের বন্ধুত্বের সূচনা। এই বন্ধুত্বের সূত্রেই শম্ভুনাথ হয়ে উঠলেন বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক কাজের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। তাই ১৮৫৫ সালের ৫ ডিসেম্বর, যখন বিদ্যাসাগর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে প্রথম বিধবা বিবাহের আয়োজন করলেন, তখন বরের পাল্কিতে বেহারা হলেন উৎসাহী শম্ভুনাথ। এরপর প্রতিটি বিধবা বিবাহেই দেখা গেল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। 

নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের মাঝেও মেয়ে মালতীকে বেথুন স্কুলে পড়তে পাঠাচ্ছেন যে মানুষটি, বিধবা বিবাহে উৎসাহ দিচ্ছেন যিনি; সেই শম্ভুনাথ পণ্ডিত বহুবিবাহ করছেন শুধুমাত্র স্ত্রীর উৎসাহে, সামাজিক চাপে। এমন বৈপরীত্যতাও ছিল তাঁর চরিত্রে। প্রথমা স্ত্রী মালো রানী ছিলেন স্বজাতীয়, লক্ষ্মৌর মেয়ে। মালোর মৃত্যু হলে, শম্ভুনাথ ভালোবেসে বিয়ে করেন বাঙালি মেয়ে হরিদাসীকে। কিন্তু বিজাতীয় মেয়েকে বিয়ের অপরাধে জ্ঞাতিরা তাঁকে ত্যাগ করে। তখন অপরাধবোধ থেকে হরিদাসীও তাঁকে অনুরোধ করেন একটি স্বজাতীয় মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। তখন তিনি বিয়ে করলেন স্বরূপ রানীকে। জানা যায়, এই প্রায়শ্চিত্তে তাঁর জ্ঞাতিরা তাঁকে ক্ষমা করেছিলেন। 

জীবনে বৈপরীত্যতা, খুঁটিয়ে দেখলে অনেকের জীবনেই মেলে। তাই বলে তাঁর হিতকর ও সংস্কারমূলক কাজগুলোকে মোটেই উপেক্ষা করা যায় না। শম্ভুনাথের এমন কাজের খতিয়ান প্রচুর। হিন্দু কলেজে আইনের অধ্যাপনা ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে আইনের পাঠ্যসূচীর বিন্যাস, কপর্দকশূন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ব্যারিস্টারি করে কলকাতা হাইকোর্টে উপার্জনের সুযোগ করে দেওয়া, ১৮৬৩'র আগুনে ছাই হওয়া ভবানীপুরকে নতুন করে গড়ে তোলার মতো কাজও তিনি নেতৃত্ব দিয়ে করেছেন।  এছাড়া অভিধান সম্পাদনা, স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ও মাদক নিবারণ সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংস্কৃত-সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন আজীবন তিনি দেখে গেছেন। মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে প্রয়াত এই মানুষটিকে উনিশ শতকের অনেক সংস্কারকের সঙ্গে আমরা আজ বিস্মৃত হয়েছি।  তাঁর নামটি শুধু জানি নগর কলকাতার বুকে তাঁর বসতবাড়ির সামনে এগিয়ে চলা রাস্তাটি এবং একটি হাসপাতালের নাম থেকে। অবশ্য, তাঁর মৃত্যুর অল্পদিন পরে স্মৃতিরক্ষার জন্যই 'পিপল পাতি রোড'-এর নাম দেওয়া হয়, 'শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিট' আর 'ভবানীপুর হাসপাতাল' হয়, 'শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল'।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...