রাজশেখর বসুর সাহিত্যজীবনে আসাটা পাকেচক্রে পড়েই সম্ভব হয়েছিল। চক্রটি স্থাপিত হয়েছিল তাঁর পার্সিবাগানের বাড়িতে। তিনি যার নাম দিয়েছিলেন, 'আর্বিট্রারি ক্লাব'। এর একটি যথেষ্ট জটিল বাংলা নামও দেওয়া হয়েছিল, 'উৎকেন্দ্র সংঘ'। এই ক্লাবে আড্ডা দিতে আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, জলধর সেন, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রকুমার সেনের মতো সেকালের নামকরা সব শিল্পী-সাহিত্যিক-পণ্ডিত। সেখানে আড্ডা তো হতোই, সেইসঙ্গে সদ্য লেখা সাহিত্য পাঠ করেও শোনাতেন সাহিত্যিকেরা। তবে, নিজে না হেসে বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতায় অন্যকে হাসিয়ে পেটে খিল ধরানোর গুণ নিয়ে ক্লাবের মধ্যমণি হয়ে থাকতেন স্বয়ং রাজশেখর বসু।
রাজশেখরের তখন বেয়াল্লিশ বছর বয়স। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে গড়া 'বেঙ্গল কেমিক্যাল'-এর তিনি তখন সর্বময় কর্তা। বেনেব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিত্য সাক্ষাৎ হচ্ছে। ধান্দাবাজ ও ধান্দাবাজির হাজার ফিরিস্তি দেখে খুব রাগ হতে লাগল তাঁর এই জাতটার ওপর। আর এই রাগটাই একদিন স্যাটায়ার গল্পের রূপ নিল, লিখে ফেললেন, 'শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড'। তাঁর প্রথম লেখা গল্প। পড়ে শোনালেন উৎকেন্দ্র সংঘের আড্ডাধারীদের। গল্প শুনে সবাই দারুণ তারিফ করলেন। ব্যঙ্গরসের যেন নতুন এক স্বাদ পেলেন তাঁরা। অমনি 'ভারতবর্ষ'-পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন লাফিয়ে উঠলেন, এ গল্প তাঁর চাই, পত্রিকায় ছাপবেন। কিন্তু স্বভাব লাজুক রাজশেখর কিছুতেই ছাপতে দিতে রাজি নন। তিনি রসায়নের লোক, সাহিত্যের রসের ভিড়ে নিজেকে ভেড়ানো কি ঠিক হবে! তাছাড়া, স্কুলে পড়তে দু'একটা পদ্য আর বেঙ্গল কেমিক্যালের বিজ্ঞাপন লেখা ছাড়া সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর তেমন কোন যোগই তো নেই। না, না এ হয় না! কিন্তু এসব যুক্তিতে তিনি পার পেলেন না। জলধরের হয়ে সবাই মিলে একেবারে তাঁকে চেপে ধরলেন। তখন অবশ্য তিনি ছাপতে দিতে নিমরাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিলেন, লেখক হিসেবে তাঁর নাম দেওয়া যাবে না। তা না যাক, লেখাটা তো ছাপা হোক! সে না হয় একটা ছদ্মনাম দিয়ে দিলেই হবে, কত সাহিত্যিকই তো আজকাল ছদ্মনামে লেখেন! ব্যস, সবাই মিলে ভাবতে বসলেন ছদ্মনামটা হবে কি! সে এক মাথাধরা কাণ্ড! ইনি এক বলেন তো, উনি নাকচ করেন; উনি যেটা বলেন, সেটা তিনি নাকচ করেন! এমনধারা যখন চলছে, তখন মুশকিল আসান হয়ে এলেন তারাচাঁদ পরশুরাম নামের এক ব্যবসায়ী। না না, তিনি নাম খুঁজে দিতে আসেননি; এসেছিলেন নিজের ধান্দায় রাজশেখরের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু লোকটার পদবীটা এমনই চমৎকার ছিল যে, সেটা হাইজ্যাক করে ছদ্মনাম বানিয়ে ফেলতে দ্বিধা হলো না কারো। ব্যস, তারাচাঁদ পরশুরাম জানলই না, 'ভারতবর্ষ'-এ 'শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড'- তারই পদবী ঝেড়ে 'ছদ্মনাম' বানিয়ে বেরিয়ে গেল! কিন্তু, বাংলার পাঠক বুঝলেন বাংলা সাহিত্যে এক শক্তিশালী লেখকের আবির্ভাব ঘটল। অমনি পাঠকের চাহিদা বুঝে জলধর একেবারে ছেঁকে ধরলেন রাজশেখরকে, আরও গল্প চাই। একটা যা হোক করে লিখে ফেলেছেন, আর না--রেহাই চাইলেন রাজশেখর। উঁহু, রেহাই নেই--সাফ জানালেন জলধর। কাজেই, 'চিকিৎসা-সঙ্কট', 'মহাবিদ্যা', 'লম্বকর্ণ', 'ভূশন্ডীর মাঠে'--র মতো দারুণ দারুণ সব গল্পগুলো লিখে ফেলতে হল। তখন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন যে, এমন গল্প তো পত্রিকার পাতায় পড়ে পড়ে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না! বই করতে হবে। তো, বই হল, 'গড্ডলিকা'। প্রথম বই। প্রকাশিত হল, বাংলা ১৩৩২ সালে। বইটি প্রকাশিত হতেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রিভিউ করলেন প্রমথ চৌধুরী 'সবুজ পত্র'-এ আর রবীন্দ্রনাথ করলেন 'প্রবাসী'-তে। এখানেই শেষ নয়। রবীন্দ্রনাথ প্রফুল্লচন্দ্রকে চিঠিতে লিখলেন, 'আমি রস-যাচাইয়ের নিকষে আঁচড় দিয়ে দেখলাম আপনার বেঙ্গল কেমিক্যালের এই মানুষটি একেবারেই কেমিক্যাল গোল্ড নন, ইনি খাঁটি খনিজ সোনা।'
কবিগুরুর সার্টিফিকেট পাবার পর দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর রইল না। রসায়নের মানুষটি রসের জোগানদার হয়ে উঠলেন। ধার করা নামটি দিয়ে তিনি লিখতে লাগলেন তাঁর ব্যঙ্গসাহিত্য ছোটগল্প। কিন্তু, 'চলন্তিকা' বাংলা অভিধান, 'রামায়ণ' ও 'মহাভারত'-এর সারানুবাদ এবং প্রবন্ধের মতো সিরিয়াস সাহিত্য তিনি নিজের নামেই লিখে চললেন। জনপ্রিয়তা বা বিক্রির নিরিখ ছাড়াও প্রকাশক ও মুদ্রাকরের তিনি বড় প্রিয় হয়ে উঠলেন। কারণ, তাঁর পাণ্ডুলিপিতে কোনো কাটাকুটি স্থান পায় না, মুক্তোর মতো হাতের লেখায় প্রতিটি অক্ষর সুন্দর সমান। সারাজীবনে একটাও উপন্যাস না-লিখে শুধুমাত্র ছোটগল্প রচনার মধ্য দিয়েই পরশুরাম রাজশেখর বসু বাংলা সাহিত্যে অমর। শুধু তাঁর নাম ও সাহিত্য হয়ে উঠল সমকালের রিপ্রেজেন্টেটিভ।
তাই রবীন্দ্রনাথ যেমন চলমান বর্তমানকে ধরতে গিয়ে 'শেষের কবিতা'য় অমিতর সুনীতি চাটুজ্যের ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক বই পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তেমনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন ব্যোমকেশের রাজশেখর বসু কৃত 'মহাভারত-সারানুবাদ' পড়ার কথা।