'ছোটবেলা থেকেই নিন্দা আমার অঙ্গের ভূষণ!'- সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন আর এক সাহিত্যিক প্রতিভা বসু। ছোটবেলায় গান শিখতেন বলে পাড়া প্রতিবেশী ঠারেঠোরে-স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে ছাড়েনি, এ মেয়ে নির্ঘাত গোল্লায় যাবে! ওস্তাদজীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গান তোলার সময় তাঁদের মিলিত কণ্ঠ সেইসব শুভাকাঙ্ক্ষীরা শুনে যাতে নতুন ও কুৎসিত গল্প তৈরি করতে না পারে, তারজন্য দরজা জানালা বন্ধ করে গান শিখতে হতো। তবে বাবা আশুতোষ সোম ও মা সরযূবালা সেই কুকথার পাকে পড়ে মেয়েকে আতুপুতু করে মোটেই মানুষ করতে চাননি। যদিও, প্রতিভা সেই বয়সে ছিলেন বড্ড ছিঁচকাঁদুনে। মনে সামান্যতম আঘাতও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তবে বাবামায়ের আগ্রহে ও উৎসাহে প্রতিভা সভায়-অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। তাঁর ডাক নাম ছিল, 'রানু'। 'রানু সোম'- নামেই সমস্ত ঢাকা শহরে তখন সুকণ্ঠী প্রতিভার খুব নাম। এগারো বছর বয়সে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বেরুল। চোঙওয়ালা কলের গানের দৌলতে নাম ছড়ালো এপার-ওপার তামাম বঙ্গে। এর মধ্যেও পাড়াপ্রতিবেশীর ছিঃছিঃক্কার চলছিল বহাল তবিয়তে।
রানু তখন কিশোরী। সুরকার ও গীতিকার দিলীপকুমার রায় তখন কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এসেছেন। ঘরোয়া এক আসরে রাণুর সুকণ্ঠের পরিচয় পেয়ে নিজে থেকেই গান শেখাতে চাইলেন তাকে। দিলীপকুমারের মতো এমন গুণী মানুষ গান শেখাতে চাইছেন, এর চেয়ে সৌভাগ্যের আর কি হতে পারে! শুরু হল তালিম। গুণী শিক্ষক গুণী ছাত্রীকে পেয়ে দারুণ খুশি। তাই দেখে গা জ্বলতে লাগল পাশের বাড়ির লোকের। তারা আবদার করলো, তাদের বাড়িতেও পায়ের ধুলো দিতে হবে দিলীপকুমারকে। উঁহু, অসম্ভব--দিলীপকুমার ভণিতা ছাড়াই জানালেন। তাতেই পাশের বাড়ি রানুদের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দিল।
দিলীপকুমারের প্রিয়বন্ধু নজরুল ইসলাম এর কিছুদিন পর ঢাকায় এলেন। দিলীপকুমারের কাছে তিনি রাণুর খুব নাম শুনেছেন, তাঁর ইচ্ছে তাকে নিজের গান শেখাবেন। ব্যস, চেনা নেই জানা নেই আলাপ নেই দুম করে হানা দিলেন রানুদের বাড়িতে। প্রাণখোলা মানুষ নজরুল অল্পসময়ের মধ্যেই জমিয়ে ফেললেন। আর এই একসাক্ষাতেই, চা আর বাটা ভর্তি পান আনিয়ে হারমোনিয়াম টেনে গান শেখাতে শুরু করে দিলেন রানুকে। সবার সঙ্গে নজরুলের এমন আত্মীয়তা গড়ে উঠল যে, বাড়ির কাজের মহিলা ও রানুর পিসিমা নজরুলের গায়ের রঙ কালো বলে তাঁকে 'কালো কেষ্ট' বলে ডাকতে শুরু করলেন। সুরসিক নজরুল তাঁদের সেই ডাকনামকে সম্মান দিতেই জীবনে প্রথম লিখলেন কীর্তন গান। রানুকেও শেখালেন। ঢাকা থেকে কলকাতায় ফেরার দিনদুই আগে গান শিখিয়ে খেয়েদেয়ে রানুদের বাড়ি থেকে বেরুতে নজরুলের রাত প্রায় দশটা বাজল। রাস্তা শুনশান। নজরুল হাঁটতে হাঁটতে চলেছেন। হঠাৎ কয়েকটা ছেলে লাঠি দিয়ে পেছন থেকে নজরুলকে আক্রমণ করল। আস্ফালন করে বলল, টাকমাথা নিয়ে দিলীপকুমার বাঁচলেও নজরুলের বাবরি মাথা আজ তারা ফাটাবেই! রানুর সঙ্গে গান শেখানোর ছলে নজরুলের নোংরা সম্পর্কের কুৎসিত ইঙ্গিত করে গালাগালি দিতে লাগল। সেই অপমানজনক মিথ্যে শুনে নজরুল ক্ষেপে গিয়ে তাদের একজনের হাত থেকে লাঠি ছাড়িয়ে নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন। তবে, ভয় পেয়ে তারা চলে যাবার আগে নজরুলকে দারুণ জখম করে গেল! পরে জানা গিয়েছিল, এসব পাশের বাড়ির যোগসাজসেই সম্ভব হয়েছিল। তাতেও রানুর নামে কুৎসিত নিন্দেমন্দের ঘাটতি হল না।
এর বছর দুয়েক পরে পাড়ায় রানুরা একটি নাটকে অভিনয় করলেন, বুদ্ধদেব বসুর লেখা। লেখকের সঙ্গে তখন তাঁর সবে আলাপ হয়েছে, অনুমতি পেতে অসুবিধে হল না। এই নাটক স্থানীয় প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে ছেলেদের চরিত্র ছেলেরা এবং মেয়েদের চরিত্র বাড়ির মেয়েদের দিয়ে করিয়ে নেবার যে স্পর্ধা রানু দেখিয়েছিলেন, তার জন্যও নিন্দার পাহাড় ডিঙোতে হল তাঁকে। 'রবিবারের লাঠি' নামে একটি পত্রিকা তাঁকে চরিত্রহীন পর্যন্ত প্রমাণ করতে বাদ দিল না।
ইতিমধ্যে রানু সোম অর্থাৎ প্রতিভা সোম সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে প্রতিভা বসু হয়েছেন। প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয় সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছেন। এই অবসরে বুদ্ধদেবের আগ্রহে তিনি লিখলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস, 'মনোলীনা,' ১৯৪০ সালে। 'গর্ভধারণ' শব্দটা তাঁর জীবনে তাই বড় ব্যঞ্জনাময়। উপন্যাসটি বই হয়ে বেরোল, ১৯৪৪ সালে। এটি শুধু তাঁর প্রথম উপন্যাসই নয়, লেখিকার ভাষায় : '' বিবাহিত মেয়ের স্বামী বর্তমানেও প্রেমে পড়ে পুনর্বিবাহের গল্প হিসেবেও প্রথম।" থিমটা সময়ের হিসেবে অনেক এগিয়ে ছিল বলেই 'গেল গেল' রব তুলে 'শনিবারের চিঠি' তাঁকে বেশ কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করল। প্রতিভাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই 'শনিবারের চিঠি'-র গালাগালি পড়ে, তিনি খুব রেগে গেলেন। মারবেন ভাবলেন গালাগালির লেখককে। আর তখনই শুরুর সংলাপটি শোনা গিয়েছিল প্রতিভার মুখে। প্রচলিত সমাজের নেতির যে পরিচয় তিনি মেয়ে হিসেবে, নারী হিসেবে পেয়েছিলেন; 'সকল কাঁটা ধন্য করে' সেই অভিজ্ঞতাই তাঁর সাহিত্যে সৃষ্ট নারীচরিত্রের মেরুদণ্ড শক্ত করেছে, পায়ের নীচের মাটি তৈরি করেছে, প্রতিবাদী হয়ে স্বপ্ন গড়েছে করেছে উত্তরণের।