যামিনী রায়: 'এশিয়ার পিকাসো'

বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় গ্রামের ছেলে যামিনী। ষোল বছর বয়সে এলেন কলকাতায়, 'ক্যালকাটা স্কুল অব আর্ট'-এ আঁকা শিখতে। কাটল আরও তেরোটা বছর। এই তেরো বছরে কতবার যে স্কুল ছাড়লেন আর ভর্তি হলেন তার ইয়ত্তা নেই। সবাই বুঝলেন ছেলেটি নিয়মের ফাঁদে বড্ড খামখেয়ালি। ইচ্ছে হলে ক্লাসে আসে, নইলে আসে না। নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে একদিন একান্তে যামিনী যখন কার্ডবোর্ডের গায়ে চৌকো ফুটো করে ফ্রেম বুঝে নিচ্ছেন, কম্পোজিশন বুঝে নিচ্ছেন; তখন সেখানে হাজির হলেন অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউন সাহেব। বুঝলেন, খেয়ালি হলেও ছেলেটির নিষ্ঠা আছে, উদ্ভাবনী ক্ষমতা আছে। এখান থেকেই যামিনী হয়ে উঠলেন তাঁর পছন্দের পাত্র। ফলে, ইচ্ছেমতন যে-কোন ক্লাসে কাজ করার অধিকার দিলেন, রোজ ক্লাসে আসার বাধ্যবাধকতা দূর করলেন, এমনকি পরীক্ষা না-দিলেও কিছু যাবে-আসবে না বুঝিয়ে দিলেন।

'ক্যালকাটা স্কুল অব আর্ট'-থেকে রীতিমতো পাশ্চাত্য চিত্ররীতিতে ওস্তাদ হয়ে বেরোলেন যামিনী। পোর্ট্রেট বা প্রতিকৃতি আঁকায় অল্পদিনেই তাঁর খুব খ্যাতি হল। তিনি এ-সময় দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীদের স্ত্রীর ছবি আঁকার বরাত পেতে শুরু করলেন। পরপুরুষের সামনে তাঁদের বেরোনো মানা, তাই আঁকতে হয় সাদাকালো ফটোগ্রাফ দেখে। প্রথমটায় এসব অর্ডারি কাজে উৎসাহ পেলেও, ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন যামিনী। মনে হল, কেন করেছেন এসব! টাকার জন্য? শুধু এর জন্যই কি চিত্রবিদ্যা শিখতে আসা?

১৯২০ সাল। হঠাৎ করেই পাশ্চাত্য রীতির পোট্রেট আঁকা ছেড়ে শুরু করলেন নতুন পথের সন্ধান। পরবর্তী সাত বছর কোন প্রদর্শনীতে যোগ দিলেন না, ছবি বিক্রির পথেও হাঁটলেন না। তখন তিনি বাগবাজারের আনন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা। বিয়ে করে সংসারী। বছর ঘুরতেই সংসারে অভাব এলো। আঁকার খরচ বাঁচাতে প্যাকিং বাক্সের বোর্ড, বই, টেলিফোন ডাইরেক্টরির মলাট হল ক্যানভাস। অভাব থেকেই শুরু হল ফ্ল্যাট টেকনিক অর্থাৎ কত কম রঙ ও রেখায় ছবি আঁকা যায়, তার নিরীক্ষা। এলো ১৯২৮ সাল। অবনীন্দ্রনাথ একদিন সেই ছবি দেখলেন। খুব খুশি হলেন। জানতে চাইলেন, 'অত: কিম?' এরপর কি? 

উত্তর দিলেন অবনীন্দ্রনাথ স্বয়ং। একটি প্রবন্ধে। স্পষ্টই বললেন যে, ভারতের চিত্রশিল্পে ভারতীয়ত্ব জিনিসটা খুবই প্রয়োজন।--আর এই কথাটাই দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলল যামিনীকে। ভারতীয়ত্ব খুঁজতে গিয়ে শুরু হল দেশজ শিল্পের অনুসন্ধান। পাশেই বিখ্যাত 'বসুবাটি'। সে বাড়ির দরজা-জানালার কাঁচে কালীঘাটের পটুয়াদের অলংকরণ। গেলেন, স্টাডি করলেন। তারপর গেলেন গ্রামের বাড়ি। গ্রামীণ পট ও টেরাকোটার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হয়ে কলকাতায় ফিরলেন। এঁকে আনলেন, 'মা ও ছেলে'-র মতো বেশ কিছু ছবি। তিনি চিত্রকলায় চাইছিলেন সচেতন শিশুমনস্কতা। সরল রেখায় ও সহজ মূর্তিতে শাশ্বতের প্রকাশ। একথা মাথায় রেখেই অনেক ছবি আঁকলেন, তবু, মন তৃপ্ত হল না। 

সেদিন উদাস হয়ে বসে।  চার বছরের ছেলে অমিয় স্লেটে ছবি এঁকেছে, দেখাতে এলো। ছবিটা এক ঝলক দেখলেন যামিনী, তারপরই চাবুকের মতো সোজা হয়ে গেলেন।  সহজ রেখায় আঁকা মুখমণ্ডল, আর সেই মুখমণ্ডল ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসছে টানা টানা পটল চেরা দুই চোখ। শিশুমননের কি অপূর্ব প্রকাশ! সীমার মাঝে অসীম। এর সন্ধান পেলেন ছেলের কাছে। তার কাছেই যেন শিখলেন। পটের সহজ রেখা আর শিশুর সরল প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে পরিণত মনের জীবন-দর্শন মিলে তৈরি হল যামিনী রায়ের চিত্রশৈলী। 

নতুন শিল্পরীতিটি সম্পর্কে আগ্রহী বিদগ্ধজন শহীদ সুরাবর্দী, সুধীন দত্ত, মৃণালিনী এমারসন, অরুণ সিংহ, বিষ্ণু দে'র প্রশংসাধন্য হলেন যামিনী। তাঁকে বলা হতে লাগল, 'এশিয়ার পিকাসো'। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এদেশে আসা আমেরিকান সৈন্যরা তাঁর ছবির প্রতি আকৃষ্ট হল। হঠাৎ তাঁর ছবির চাহিদা ও বিক্রি বেড়ে গেল। এই সাফল্যে তৈরি হয়ে গেল বিরুদ্ধপক্ষ। তাঁরা যামিনীর শিল্পীসত্তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে নিছক 'পটুয়া'-বলে চিহ্নিত করলেন। বিরুদ্ধ কাগজে প্রচার চালাতে লাগলেন : যামিনী রায় আবার শিল্পী নাকি! পটুয়া হে, পটুয়া। ওঁর স্টুডিও তো আর স্টুডিও নেই; সে তো এখন ছাপাখানা! দিনরাত একই পট নকলের পর নকল হচ্ছে! ছেলের কাজ বাপের নামে যাচ্ছে! শিল্পের নামে লোকঠকানো হচ্ছে!--হ্যাঁ, তাঁদের বিরুদ্ধতার ভাষা অনেকটা এরকমই।

খদ্দরের ধুতি-ফতুয়া পরা সাদামাটা মিতবাক মানুষটার শিল্পীসত্তা অপমানে দিনের পর দিন ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। তবু, উষ্মা প্রকাশ করলেন না। অভিযোগের জবাব জানলেন শুধু ঘনিষ্ঠমহল : "আমি চাই দেশের ঘরে ঘরে ক্যালেন্ডার সজ্জা না করে আমার আঁকা একটা পটও টাঙাও। তাই তো আমি অল্পদামে ছবি বিক্রি করি। ছবির সংখ্যা বৃদ্ধি না হলে সরবরাহ হয় কি করে। আমার ছবির ফর্মটি আছে। ছেলেকে শিখিয়েছি। সে সাদা-মাটা রঙ গুলো ভরে দেয়, আমি সূক্ষ্ম কাজগুলো করে নিয়ে নাম লিখে দি। এতে ক্ষতিটা কি? মধ্যযুগের ইউরোপে পেইন্টার্স গিল্ড-এ এ-ধরনের প্রথা ছিল। চেলারা সাধারণভাবে ছবির জমি রাঙিয়ে দিত, ওস্তাদের তত্বাবধানে, মাস্টার পেন্টার ছবি শেষ করে সই করে দিত।"

যুগোত্তীর্ণ শিল্পীর ছবিতে দেখা ও আঁকার পরেও তৃতীয় একটি ব্যঞ্জনা থাকে, যা সমকালকে ছোঁয়। পটশিল্পীর মতো দেখা ও আঁকাতেই তাঁর কাজ শেষ হয়ে যায় না। যামিনী প্রথম -জাতের  শিল্পী বলেই লণ্ডনের বারলিংটনে অনুষ্ঠিত সুপ্রসিদ্ধ ভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে সমসাময়িক চিত্রকলার প্রতিনধিত্ব করার বিরল সম্মান পেয়েছিলেন, ১৯৪৭ সালে। শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী, জীবৎকালেই যাঁর আঁকা ছবি ভারতের ন্যাশনাল গ্যালারির স্থায়ী সংগ্রহে স্থান পেয়েছিল। 

তথ্য ঋণ: রূপতাপস যামিনী রায়- প্রশান্ত দাঁ সম্পাদিত

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...