জীবনরসের পথিকসাহিত্যিক সুব্রত মুখোপাধ্যায়

ইতিহাস তাঁকে টানতো, লোকায়ত জীবন তাঁকে টানতো আর সুর খেলতো তাঁর দরাজ কণ্ঠে। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কলমে এই টান, এই সুরের খেলাই কখনো 'রসিক' হয়ে উঠল, কখনো বা 'মধুকর', কখনো 'আয় মন বেড়াতে যাবি'। তাঁর লেখায় গবেষকের নিষ্ঠার সঙ্গে মিশে গেছে কথাকারের গভীর জীবনবোধ, জীবন-দর্শন। সহজ প্রকাশভঙ্গির মধ্য দিয়ে অনায়াসে সাররিয়াল থেকে রিয়ালে অবাধ বিস্তার তাঁর। রামপ্রসাদের জীবন ও সময়কে তিনি এ-সময়ের প্রেক্ষিতে-রসে তাই জারিয়ে নিয়েছেন সহজেই। তাঁর গদ্য সহজ, কিন্তু একান্তই নিজস্ব। বাক্যের গঠনে, শব্দের ব্যবহারে। 'আয় মন বেড়াতে যাবি'-র কয়েকটা বাক্য তুলে দিয়ে চলুন ব্যাপারটা দেখি--

এক, 'রাজলক্ষ্মী সদ্য সদ্য একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন তাঁর বাপগত মায়ের আলয়ে।' 

দুই, 'আমাদের বাড়ির পাশের মেটে রাস্তা বরাবর বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর হৃদয়নন্দিনী পরিবার রাজলক্ষ্মী দেবী সন্নিধানে চলেছেন।'

তিন, 'বাড়িটি যত্নআত্তিতে গোড়া থেকেই আছে বলে এখনও খুব টনকো।'

চার, 'বাড়ির পুরোনো চাকর রামশরণ সাইকেলটি ঠেলে দিত তিনি চড়ন্ত অবস্থায়।'

উদাহরণগুলি কাহিনীর শুরুর দিকের। সমস্ত উপন্যাসেই তৎসম শব্দের পাশে নির্দ্বিধায় আটপৌরে লোকজ শব্দের সহাবস্থান ঘটিয়ে তিনি অপূর্ব এক প্রকাশভঙ্গি তৈরি করে নিয়েছেন। কখনো বা 'পড়ন্ত'-র অনুগবয়নে সৃষ্টি করেছেন 'চড়ন্ত' অথবা 'বাপগত'র মতো শব্দ। নির্মাণ করেছেন সময়ের প্রেক্ষিতে নিজস্ব মেজাজ। এই মেজাজটাই তাঁকে চিনিয়ে দেয়। ভাষা যদি স্রষ্টাকে চিনিয়ে দিতে পারে, দর্শন যদি আত্মাকে ছুঁতে পারে; সেখানেই স্রষ্টা সার্থক। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন একালের একজন শক্তিমান ও সার্থক কথাকার। তাঁর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না, নিজস্বতার নিবিড়তায় তিনি একক।

সুব্রত মুখোপাধ্যায় একই বিষয়ের কচকচিতে কখনোই যাননি। তাই উপন্যাস থেকে উপন্যাসান্তরে রয়েছে বিষয় বৈচিত্র্য। নয়ের দশকে পুরুলিয়া-মানভূমের নাচনীজীবনের বিষাদ-উপাখ্যান আশাবাদীর প্রত্যয়ে তুলে ধরেছিলেন 'রসিক' উপন্যাসে। ঝুমুর গানের ঐতিহ্য, ভাষা ও চর্যায় আঞ্চলিকতার গন্ধমাখা এই উপাখ্যানকে দিয়েছিলেন এক মহাকাব্যিক বিস্তার। তারাশঙ্করের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'-র বহুদিন পর বাঙালি পাঠককে এই উপন্যাস একেবারে সমূলে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল। 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এই উপন্যাস। ১৯৯১ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এই উপন্যাসের জন্য তিনি বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছিলেন। 

'মধুকর' উপন্যাসটিও তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বিষয় বৈচিত্র্যে এখানে বলাগড়ে নৌকো-তৈরি করে যাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন, তাঁদের জীবনের নতুন এক ভাষ্য নির্মাণ করেছেন। তাঁর 'সন্ত্রাস', 'পৌর্ণমাসী', 'আলতাপাতা', 'বিষহর', 'বীরাসন'-ও এমনই বিষয় বৈচিত্র্যে অনন্য। ২০১২ সালে 'বীরাসন'-এর জন্য তিনি সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার পান।

সুব্রত মুখোপাধ্যায় অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন। অনুজ সাহিত্যকদের মধ্যে যাঁরা ভালো লেখেন, স্বনামধন্য হননি; তাঁদের তিনি যেমন প্রকাশিত গল্পপাঠের পরই ফোন করে তাঁর মুগ্ধতা জানিয়ে অকৃত্রিম উৎসাহ দিতেন; তেমনি তাঁদের লেখা যাতে ভালো পত্রিকায় প্রকাশ পায়, সে চেষ্টাও করতেন। নিজে প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন বটে, কিন্তু দারুণ আড্ডাবাজ ও রসিক। 'বুধসন্ধ্যা',  'গল্পপাঠ'-এর মতো সাহিত্যিক আড্ডাচক্রে গল্প-রসিকতায় তো বটেই, দরাজ গানে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। সঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। ভালোবাসা আর বিষয়ের দাবীতে গান তাঁর অনেক উপন্যাসেই চরিত্র হয়ে উঠত। মানুষটি বড় অসময়ে চলে গেলেন। তবে, তাঁর সাহিত্যে রেখে গেলেন নিজস্বতার আমূল স্বাক্ষর।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...