দুষ্টু প্রজাপতি ও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

'আচ্ছা, শুধু নাম ভালবাসা যায়?', প্রশ্ন করলেন শরদিন্দু; ডায়েরিতে উত্তরও লিখলেন নিজেই, 'বোধ হয় যায়। আমি ত নামের বেশি পরিচয় পাইনি, তবু সে পরিচয়ই আমার স্নেহ টেনে নিয়েছে।' সেটা, ১২ জানুয়ারি, ১৯১৮। সেই মুহূর্তে 'স্নেহ' তাঁর 'ভালোবাসা'-র প্রতিশব্দ। আর 'স্নেহ'-উদ্দিষ্ট কিশোরীটি হলেন, পারুল। মুঙ্গের শহরের একটি পাড়ার নাম, বেলুন বাজার। সেখানেই পারুলদের বাড়ি।

শরদিন্দু, মুঙ্গেরের জাঁদরেল উকিল তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় ছেলে। বড় বাড়ি, বিষয়সম্পত্তিও অনেক। তারওপর কলকাতায় ওয়াইএমসিএ-র হোস্টেলে থেকে তিনি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। তার মানে, 'পাত্র' ভালো। কীভাবে কোন সূত্র থেকে যে বেলুন বাজার নিবাসী শ্যামল চক্রবর্তী মশাই নাতনি পারুলের বিয়ে দেবার জন্য যাওয়া-আসা শুরু করলেন, সেটা জানা যায় না। তবে, অল্পদিনে  দু'পক্ষই মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে এলেন যে, বিয়েটা হবে।  সম্ভবত, সেটা  ১৯১৭-র শেষ দিকের ঘটনা। আর শরদিন্দু? তিনি শুধু জানলেন একটি নাম, 'পারুল'। ব্যাপারটা যেন বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের চৌহদ্দির মধ্যে পড়ে গেল। সুতরাং, নাম শুনে পূর্বরাগ হল। শুধু তাই নয়, অদূর ভবিষ্যতের প্রেমময় দাম্পত্যজীবনের ছবি আঁকাও চলতে লাগল জোরকদমে। শুধু নামটুকু সম্বল করে। অন্তরে জন্ম নিল প্রেমের কবিতামালা, তাতে লেগে রইলো অপেক্ষার রঙ।   কবিকল্পনায় শ্বশুরবাড়ি যাত্রা, সে বড় আমোদের ব্যাপার। তারই ছবি আঁকলেন 'একটি কাঠি!' কবিতায়। আর তার মধ্যে জেগে রইলো এপার-ওপার মিলনে প্রতীক্ষা--

'মোর আসিবার আশে,

আছে সে জানালা পাশে

সমুখে জ্বলিয়া নিয়া দীপশিখাটি।'

'দীপশিখাটি' কিন্তু দুম করে নিভে গেল। ১৯১৭ সালে পুরোদমে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তখনই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি কর্পস-এর মাধ্যমে মিলিটারি শিক্ষা নেবার সুযোগ এলো। শরদিন্দু তাতে যোগ দিলেন। আর এই সিদ্ধান্তই বিবাহ-মঙ্গলের আয়োজনটি ঘেঁটে ঘ করে দিলো। ব্যাপারটা কানে যেতেই কনেপক্ষের, বিশেষ করে কনের বাবার দারুণ ভয় হল: যুদ্ধ চলছে, ছেলে মিলিটারি ট্রেনিং নিচ্ছে, এবার যুদ্ধে যাবে, ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে মেয়েটার কি হবে! এ দুশ্চিন্তা খুবই স্বাভাবিক তাঁদের পক্ষে। আকারে-ইঙ্গিতে সে-কথা বুঝিয়ে তাঁরা পিছিয়ে যেতে চাইলেন। তাঁদের মনোভাব বুঝতে পেরে দারুণ কষ্ট পেলেন শরদিন্দু। কেন? কনেপক্ষের প্রত্যাখ্যান তাঁর পৌরুষে আঘাত করলো বলে? না। "...তাঁদের মনোভাবের অস্পষ্ট ইঙ্গিতটা আমায় ব্যথা দিয়েছিলকেন? বোধ হয় একটা নামের সঙ্গে মনের স্নেহ বিজড়িত হয়ে গেছেসেই নামটাকে স্নেহ থেকে পৃথক করে দিতে হবে, তাহারি বেদনায়।" (১২ জানুয়ারি, ১৯১৮)।

'পারুল'  শুধুই একটা নাম তো নয়, নামটার সমস্ত সত্তা জুড়ে একটি মানুষীর বাস্তব অস্তিত্ব আছে। 'পারুল', আসলে এক কাঙ্ক্ষিত  অবয়ব, কমনীয় কিশোরীর উৎসুক মুখ। অল্পক্ষণের পাকা দেখা, তাও তো এরই মধ্যে হয়েছে। সেই মুখ অবিরাম মনে জাগছে। পারুলকে কেমন করে ভুলবেন তিনি! সে অসম্ভব! আচ্ছা, এই যে তাঁর মনে এতকথা আসছে, এসব কি পারুলের মনেও জাগছে? এই ভরা শীতের প্রহরগুলো প্রিয়াহীন বসন্তের মতো তাঁর মনে হচ্ছে। পারুলের হচ্ছে? আচ্ছা, ওই পলক কয়েকের দেখায় পারুল কি তাঁকে ভালোবাসতে পেরেছেন? উত্তর এলো না। তাই 'বিরহী-বিলাপ' জাগল অন্তরে--

"সন্ধ্যাকালে বসি চুপি চুপি প্রান্তরে মৌনভাবে

চিন্তা করচি এহেন সময়ে প্রেয়সী কোনখানে?

চিত্তে কান্তা বিহনে এমনি ধূপ দীপালি জ্বালি

এম্নিভাবে কত দিন বল থাকিব দীন প্রাণে?"

কিচ্ছু ভালো লাগছে না। যে মিলিটারি ট্রেনিং তাঁর অত প্রিয় ছিল, সেটাকেই সব সমস্যার মূল ঠাউরে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে এক্ষুনি। কুড়ি-বাইশ দিন টানা কলেজ কামাই তো হলোই। বাড়ি যেতেও ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে খুড়তুতো ভাই নৈনার পৈতে। তাই না না করেও যেতে হল। সারাটাদিন খুব খাটুনি গেল। তখন বিকেল, বাবার খাটে ক্লান্ত শরদিন্দু চোখ বুজে শুয়ে। হঠাৎ কানে এলো মৃদু শাড়ি-চুড়ির সাবধানী আওয়াজ। কারও চুপিসাড়ে আসার খবর দিল যেন। অমনি     চোখ খুললেন শরদিন্দু, দেখলেন, দরজায় পারুল। তাঁকে চোখ খুলতে দেখেই পারুল লজ্জায় লাল হয়ে একেবারে ধাঁ করে হাওয়া। খাবার পরিবেশনের সময় শরদিন্দুর চোখ তন্নতন্ন করে খুঁজেছে পারুলকে। আর এখন..! যেন অন্তর ছুঁইয়ে দিয়ে গেলেন পারুল। "মনে হল, 'আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়নু!' আরও মনে হল, 'দেখা পেলেম ফাগুনে!'

ওই ছোঁয়াছুঁয়ির আনন্দটুকুই সার। সম্বন্ধ ভাঙেও না, এগোয়ও না। ক্যাম্প হলেই ট্রেনিং শেষ। তাই ক্যাম্পে গেলেন শরদিন্দু। হাড়ভাঙা খাটুনি, আর চরম নিয়মের মধ্যে কাটতে লাগল দিন। তার মধ্যেই মনের তিনটি স্তরে জেগে রইলেন পারুল, পারুল আর পারুল। তার মধ্যেই কি যে গ্যাঁড়াকল মুঙ্গেরে হল কে জানে, হঠাৎ মায়ের চিঠিতে(৩১.০৩.১৯১৮) শরদিন্দু জানতে পারলেন বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে, ১৩ই বৈশাখ। তার মানে, সব সমস্যা মিটে গেল? মোটেই না। তেরোর গেরোয় আরও নাটক অপেক্ষা করছিল। দিন সাতেক পর জানা গেল--পারুলের ঠাকুরদা শ্যামলবাবু অসুস্থ, তাই বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হল! হতেই পারে। খুব একটা তলিয়ে ভাবলেন না শরদিন্দু, তবে ভেতরের ব্যাপারটা টের পেলেন ক'দিন পর।

দু'মাসের ছুটিতে বাড়ি এলেন শরদিন্দু, সেটা এপ্রিলের ২৭ তারিখ।  কলকাতা থেকে প্ল্যান করে রিল নিয়ে এসেছিলেন। ছোটভাই খতু, মানে, অমরেন্দ্রকে দিয়ে লুকিয়ে পারুলের একখানা ছবি তুলিয়ে আনালেন। ছবি ভালো হলো না, তবু হলো তো।   যাইহোক, শ্যামলবাবুর অসুস্থতাটা যে অজুহাত, বিয়েটা ঠেকিয়ে রাখা আর পাত্রকে হাতছাড়া না করার যে একটা বিচ্ছিরি পরিকল্পনা, সেটা বোঝা গেল মে মাসের দশ তারিখ। ভেতরে ভেতরে তাঁরা অন্য পাত্রের খোঁজ করছিলেন। এদিন দিগম্বর চাটুজ্যের ছেলে এসেছিল পারুলকে দেখতে। মেয়েকে যখন পাত্রের সামনে আনা হল সাজিয়েগুজিয়ে, তখন পারুলের চোখ কেঁদে কেঁদে লাল। বাড়ির সবার কাছেই সেদিন পারুল  কি চান, কাকে চান স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবুও কি কারও তাতে এসে গিয়েছিল? হয়তো না। তবে, প্রেমিক শরদিন্দুর ভেতরটা পুড়তে শুরু করেছিল। খানিক রাগও হয়েছিল, খানিকটা হতাশ, খানিকটা রেখেছিলেন ভাগ্যের ওপর ভরসা--

"দুনিয়ার বুড়ো-বুড়িগুলো এতই কঠোর যে তারাও যে এককালে ছেলেমানুষ ছিল একথাটা স্বীকার করতে চায়না। এস্থলে তারা কি করবে বলা যায় না। আসল কথা আমাকে তাঁদের মোটেই পছন্দ নয়

Let me wait and hope!"

বৈষ্ণবীয় ভালোবাসার একটা অদ্ভুত টান এরমধ্যেই এক সুতোয় বেঁধে রাখলো শরদিন্দু আর পারুলের হৃদয়। সমস্ত হিসেব-নিকেশ, ক্ষুদ্রতা-নীচতা-অপমানের অনেক উপরে সেই হৃদয়ের স্থান।  হতাশায়-সংশয়ে কেটে গেল আরও দশ-এগারোটা দিন। মে মাসের ২২ তারিখ সন্ধ্যা বেলা পারুলের বাবা তিনুবাবু হাজির হলেন হঠাৎ শরদিন্দুদের বাড়িতে। এগারোই আষাঢ় ভালো দিন, ওইদিন বিয়ের দিন ঠিক করা যেতে পারে। এবার যেন কনেপক্ষের খুব তাড়া, তাদেরই সব দায়! শেষমেশ অবশ্য  বিয়ের দিন ১১ নয়, ঠিক হল ১৪ আষাঢ়, ১৩২৫ সাল। না, দুষ্ট প্রজাপতির তরফ থেকে আর কোন বাধা আসেনি, বিয়েটা সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হল। তবে অনুমান করা গেল, কনেপক্ষের তাড়াহুড়োর একটা কারণ বোধহয় ছিলেন পারুল। কলকাতার এক রাজপুত্রের মতো সুন্দর ও ধনী পাত্র এবং শরদিন্দুর মধ্যে কাকে পছন্দ জিজ্ঞেস করা হলে, পারুল নাকি শরদিন্দুকেই পছন্দ জানিয়ে লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর আর মেয়েকে ঘাঁটাতে সাহস করেননি বাড়ির হর্তাকর্তারা। আর এই খবরটি যখন দূত মারফৎ প্রেমিক শরদিন্দু কাছে এলো, তখন একুল-ওকুল দু'কুল ছাপানো  আবেগ নিয়ে ডায়েরিতে লিখলেন--'আমার হৃদয় আজ অহংকারে পূর্ণ।'

তথ্যঋণ: দিনলিপি-১৯১৮-২০-শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...