অমর পাল। তাঁর প্রভাতী গানে পাখি জেগেছে, আগমনীতে শিউলি ফুটেছে; তাঁর কণ্ঠ নাগরিক জীবনে বয়ে এনেছে হাওর-বাওরের কথা, আউল-বাউলের স্বপ্ন আর সোঁদামাটির সুঘ্রাণ। সেই কণ্ঠ চিরনতুন, সেখানে কোনদিন বার্ধক্য বাসা বাঁধতে পারেনি। শুধু বেসিক রেকর্ড নয়, বাংলা চলচ্চিত্রেও কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তবে, 'কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়'-গানটি তাঁর কণ্ঠে সর্বজনপ্রিয় হলেও, গানটি তাঁকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করলেও প্লেব্যাকশিল্পী হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে'-তে হয়নি। হয়েছিল, তারও প্রায় দু'দশক আগে। তখন, বিখ্যাত পরিচালক দেবকী কুমার বসু 'চাষী'-নামে একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। এই ছবিতেই দেবকীবাবু তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন লোকগান, 'ধান কাটি, কাটি ধান'। ছবির নায়ক শম্ভু মিত্র, নায়িকা তৃপ্তি মিত্র। শিল্পী হিসেবে অমর পাল ছিলেন দেবকীবাবুর খুব পছন্দের পাত্র। তাই এই পছন্দের মানুষটিকে তিনি শুধু গান গাইয়েই তৃপ্ত হতে পারলেন না, তাঁকে দিয়ে অভিনয়ও করালেন। ছয়ের দশকের শুরুতে, 'সাগর সঙ্গম'-ছবিতে। কালাচাঁদ বাউলের চরিত্রে। স্বভাবতই অমরবাবু গানও গেয়েছিলেন এই ছবিতে, রাইচাঁদ বড়ালের সুরে। তিনি যে শুধু দেবকীবাবুর স্নেহধন্য ছিলেন, তাই নয়; বিখ্যাত পরিচালক তপন সিনহা-অরুন্ধতী দেবীরও খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে এই সঙ্গীতরসিক দম্পতির বাড়িতে নিয়মিত বসত গীতিমুখর আড্ডা। ১৯৬৯ সালে অরুন্ধতী যখন 'মেঘ ও রৌদ্র'- ছবিটি পরিচালনা করলেন, তখন তাতে লোকগান গাওয়ালেন অমর পালকে দিয়ে। এর আগে পীযুষ বসুর 'শিউলি বাড়ি' (১৯৬২) এবং এর পরে সুনীল বসু মল্লিকের 'নিষ্কৃতি' (১৯৭৮), দিলীপ রায়ের 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে' (১৯৮২) এবং আটের দশকের শেষ দিকে নৃপেন গাঙ্গুলীর 'ভোম্বল সর্দার' ছবিতেও তিনি গান গেয়েছেন। মধ্যিখানে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর কাজ। সত্যজিৎ তখন 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' ছবির দ্বিতীয় পর্ব, 'হীরক রাজার দেশে' করবেন বলে ঠিক করেছেন। এ-ছবিতে একটি চারণ চরিত্র আছে, চরণদাস, সে গাইবে বাউল অঙ্গে গান। চারণ চরিত্রের জন্য সত্যজিতের চাই চারের দশকের গায়ক-নায়ক রবীন মজুমদারকে আর তাঁর গানে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য চাই লোকসঙ্গীতের জাদুকর অমর পালকে। রবীন মজুমদারকে খুঁজে আনার দায়িত্ব বর্তালো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ওপর। আর অমর পালকে ডেকে আনার দায়িত্ব সত্যজিৎ দিলেন গুপীবাঘা সিরিজে, গুপীর কণ্ঠ, অনুপ ঘোষালকে।
সুতরাং, অমরবাবু একদিন এলেন সত্যজিতের বাড়িতে। সত্যজিৎ তাঁর কণ্ঠে গান শুনতে চাইলেন। অমরবাবু গাইলেন--'এ ভব সাগর রে'। গান শুনে সত্যজিৎ খুব খুশি। অমরের কণ্ঠে এক অপূর্ব মাদকতা আছে, সেখানে একইসঙ্গে অতীন্দ্রিয় ভাব আর মাটির গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়! এই তো চাই। সুতরাং, লিখে ফেললেন গান। সহজ সুরে সহজ কথায়, 'কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়'। গান তৈরি হতেই আবার ডাক পড়ল। গান তোলাবেন। পিয়ানোয় বসলেন সত্যজিৎ। বার দুই গেয়ে শোনালেন, তারপর হাতে দিলেন স্বরলিপি। এভাবেই কণ্ঠে উঠল গান। তখন কে জানত যে, এ-গান নিশ্চিত ক্লাসিক হবে! বিভিন্ন ইন্টারভিউতে অমরবাবু জানিয়েছেন, দেশে-বিদেশে অনেক সম্মান, অনেক পুরস্কার পেলেও এ-গানের জন্যই তিনি পেয়েছিলেন জীবনের সেরা পুরস্কার।
'হীরক রাজার দেশে'-ছবি রিলিজের বেশ কিছুকাল পরের কথা। তিনি একবার জলসা করতে বোম্বে গেলেন। অনুষ্ঠানের শেষে উদ্যোক্তাদের একজন তাঁকে খুব করে অনুরোধ করলেন কাছেই একটি বাড়িতে যাওয়ার জন্য। ভদ্রমানুষ অমরবাবু অনুরোধ রক্ষা করলেন। গেলেন সে বাড়িতে। কিন্তু, উদ্যোক্তা ভদ্রলোক যাঁর কাছে নিয়ে গেলেন, তিনি তখন খাচ্ছিলেন। অমরবাবু চিনলেন, মানুষটি রাজ কাপুর। উদ্যোক্তা আলাপ করিয়ে তাঁকে অমরবাবুর পরিচয় দিয়ে বললেন যে, ইনিই সেই বিখ্যাত গায়ক, যিনি সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গান গেয়েছেন। তাই শুনে খাবারমাখা এঁটো হাতেই সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন রাজ। সেই হাতেই অমরবাবুর হাত চেপে ধরলেন, 'আপনার তো দারুণ সৌভাগ্য, তাঁর ছবিতে এতো ভালো গান গেয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন! আমার তো সে আশা কিছুতেই পূরণ হল না এখনো!' বলেই জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। অমরবাবু বুঝলেন, সত্যজিতের মতো মহান পরিচালকের সঙ্গে কাজ করাটাই আসলে মস্তবড় পুরস্কার। যার স্বীকৃতি দিলেন আর এক জগৎবিখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক রাজ কাপুর। ততক্ষণে রাজের হাতের এঁটো সব লেগে গেছে পাঞ্জাবিতে। অমরবাবু সেই পাঞ্জাবিটা রেখে দিয়েছিলেন সারাজীবন তেমনিভাবেই, তাঁর কাছে এ-হল স্বীকৃতিরই স্বাক্ষর।
তথ্যসূত্র : অমর পালের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং তরুণ সেন ছদ্মনামে মৎপ্রণীত 'অমরশিল্পী অমর পাল'।