বাংলা চলচ্চিত্রের এক বহুমুখী প্রতিভা বিকাশ রায়

১৯৪৭ সাল, অথচ দেশ তখনও পরাধীন। এ-বছরই ৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেল একটি ছবি, যার নাম, 'অভিযাত্রী'। পরিচালক, হেমেন গুপ্ত। ছবিটি ছ'টি কারণে বিশিষ্ট। এক, এ-ছবিতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরকার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেন। দুই, 'উদয়ের পথে'র নায়িকা বিনতা বসু (রায়)-এর এটি 'কামব্যাক' ছবি। তিন, 'উদয়ের পথে'-র কাহিনিকার জ্যোতির্ময় রায় এ-ছবির কাহিনি লিখলেন, এমনকি প্রযোজকও হয়ে উঠলেন। চার, নট শম্ভু মিত্রের চলচ্চিত্র-জীবন শুরু হল এই ছবিতে অভিনয় দিয়ে। পাঁচ, ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি অব্দি নতুন ছবি মুক্তি পেত মাত্র দু'তিনটি প্রেক্ষাগৃহে। কিন্তু, 'অভিযাত্রী'-ই প্রথম ছবি; যা একসঙ্গে সাতটি প্রেক্ষাগৃহ--'বীণা', 'পূর্ণ,' 'খান্না,' 'নবরূপম,' 'পারিজাত,' 'আলোছায়া,' 'অলকা'-তে মুক্তি পেয়ে ইতিহাস তৈরি করল। ছয়, এই ছবির মধ্য দিয়েই বাংলা চলচ্চিত্র জগতে অভিনেতা বিকাশ রায়ের আত্মপ্রকাশ হল। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। 

চরিত্রাভিনেতা হলেও, তাঁর অভিনয় পরিচালক হেমেন গুপ্তের ভীষণ ভালো লেগে গেল। তাঁর পরের ছবি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, 'ভুলি নাই'।  এই ছবিতে বিকাশ রায়কে দিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র, বিকাশ অভিনয়ও করলেন অসাধারণ। কিন্তু, ছবিটি দেশের অন্যান্য প্রদেশে মুক্তি পেলেও, বাংলার তৎকালীন প্রাদেশিক সেন্সার বোর্ড চক্রান্ত করে ছবিটিকে কিছুতেই মুক্তি তো দিলই না, নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। পরের ছবি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, 'বেয়াল্লিশ'। এ-ছবি বিকাশ রায়কে একইসঙ্গে কুখ্যাত ও বিখ্যাত করে তুলল। তাঁর চরিত্রটির নাম ছিল, মেজর ত্রিবেদী। অত্যন্ত নিষ্ঠুর-স্যাডিস্টিক চরিত্র। বিকাশ তাঁর অভিনয়দক্ষতায় চরিত্রটিকে এমন বাস্তব রূপ দিলেন যে,  দর্শক অভিনেতা এবং চরিত্রকে এক করে ফেলল। ফলে, মেজর ত্রিবেদী চরিত্রের প্রতি তাঁদের যে রাগ, সব গিয়ে পড়ল অভিনেতা বিকাশ রায়ের ওপর। অনেকেই তাঁকে মারার জন্য বাড়ির কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে শুরু করলো। ফলে, বাড়ি থেকে বেরনোটাই হয়ে উঠল দারুণ ঝক্কির। সেই ঝক্কি তাঁকে পোয়াতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন। অভিনেতার জীবনে এ একইসঙ্গে প্রাপ্তি এবং বিড়ম্বনা।

বিকাশ রায় তাঁর চলচ্চিত্র-জীবনে আড়াইশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে পঞ্চাশের বেশি ছবিতে তিনি নায়ক। একই সঙ্গে নায়ক এবং খলনায়ক বা চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেও যে দর্শকের কাছে সমানভাবে আদৃত হওয়া যায়, এটা বিকাশ রায় তাঁর অভিনয় প্রতিভা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন। 

ভবানীপুরের ছেলে বিকাশ রায় প্রথম জীবনে কিন্তু অভিনেতা হতে চাননি। স্কুলজীবনে থিয়েটার বা সিনেমার প্রতি তাঁর কোন আগ্রহও ছিল না। আগ্রহ ছিল সাহিত্যে। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় কলেজের ম্যাগাজিনে সাহিত্যচর্চা চালাতে চালাতে মনে কিছু একটা করার তাগিদ এলো। সুতরাং, 'বেদুইন'-নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করে ফেললেন। তা নিয়ে মাতামাতি করতে করতে কলেজ শেষ হল। আর তখনই, ভবী বোধহয় অলক্ষ্যে হাসলেন। সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকা উচিত, নাকি, কোন প্রচলিত প্রফেশনে যাওয়া উচিত--এই নিয়ে মনের মধ্যে শুরু হল দ্বন্দ্ব। এলো অস্থিরতা। পথ খুলল বর্ণময় অভিজ্ঞতার, শুরু হল বিচিত্র কর্মজীবন। 

প্রথমেই সাহিত্য-পথ ছেড়ে আইন-পথে হাঁটতে গেলেন। বি এল পাশ করে আলিপুর কোর্টে শুরু হল প্র্যাকটিস। ভালো লাগল না। তখন এক বন্ধুর সহায়তায় আকাশবাণীতে যোগ দিলেন। হলেন, মাস মাইনের শিল্পী। কোনরকমে মাস-চার কাটল। ভালো লাগল না। কাজ নিলেন ডি জে কিমারের বিজ্ঞাপন দপ্তরে। না, এখানেও ভালো লাগল না। আবার ফিরলেন আকাশবাণীতে। তবে, এবার হয়ে এলেন,  প্রোগ্রাম এসিস্ট্যান্ট। এ-হল ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ অব্দি, পাঁচ বছরের ফিরিস্তি।

দ্বিতীয়বার আকাশবাণীতে ফেরার পর তাঁর আলাপ হল 'উদয়ের পথে'-র কাহিনিকার জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে। বন্ধুত্বও হল। মাঝে মাঝেই আড্ডা জমে উঠতে লাগল। একদিন কথায় কথায় জানা গেল, 'উদয়ের পথে'-র নায়িকা বিনতাকে জ্যোতির্ময় বিয়ে করেছেন। বিয়ের জন্য অভিনয়ে একটা ব্রেক নিয়েছিলেন বিনতা। এখন আবার অভিনয়ে ফিরছেন। সে-জন্য 'অভিযাত্রী' নামে ছবির গল্প লিখে ফেলেছেন জ্যোতির্ময়। প্রযোজনাও তিনিই করবেন। ছবিতে 'উদয়ের পথে'-র হিট জুটি রাধামোহন ভট্টাচার্য ও বিনতা-দুজনেই থাকবেন। চিত্রনাট্য লিখেছেন হেমেন গুপ্ত। পরিচালনাও হেমেনবাবুই করবেন। পরিচালক দেবকীবাবুর কাছে কাজ শিখেছেন ভদ্রলোক। প্রথম ছবি 'দ্বন্দ্ব' যদিও চলেনি। তবে ভদ্রলোক কাজ জানেন। এসব কথার মাঝে হঠাৎ জ্যোতির্ময় বলে বসলেন যে, একটা ভালো ক্যারেক্টার আছে, বিকাশকে মানাবে ভালো। বিকাশ যদি রাজি হন, তাহলে হেমেনবাবুকে তিনি বলে দেবেন। বিকাশ তো আকাশ থেকে পড়লেন! বলেন কী! অভিনয়! প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে বন্ধুদের অনুরোধে একবার শুধু 'বৈকুণ্ঠের উইল'-নাটকে অভিনয় করেছিলেন। অভিনয়ের সঙ্গে যোগই বলুন আর যোগাযোগই বলুন, ওইটুকুই। জ্যোতির্ময় হেসে জানালেন যে, ওতেই হবে। হেমেনবাবু আছেন, কোন ভয় নেই! অভয় পেয়ে বিচিত্রকর্মা বিকাশ ভাবলেন, কিছু না হোক, একটা অভিজ্ঞতা তো হবে। আর ভয় যখন নেই , তখন ঝাঁপিয়েই পড়াই যাক না হয়। তবে, শুধু ঝাঁপিয়েই পড়লেন না, ভালোবেসে ফেললেন অভিনয়কে। শুরু হল সিনেমাজীবন। তৈরি হল ইতিহাস।

অভিনয়ে যখন এলেনই, তখন নাটকই বা বাদ যায় কেন? যোগ দিলেন পেশাদারী মঞ্চ রঙমহলে। প্রথম অভিনয়, 'পথের দাবী' নাটকে অপূর্বর ভূমিকায়। পরে অভিনয় করলেন শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গেও। সাতের দশকে তপন থিয়েটারে সত্য বন্দোপাধ্যায়ের 'নহবত' নাটকেও অভিনয় করলেন। আলোড়ন তুলল এ-নাটক, অতিক্রম করল 'হাজার রজনী'। 

অভিনয়ে যখন এলেন, তখন প্রযোজনাই বা বাকি থাকে কেন? ১৯৫০ সাল। পরিচালক অজয় করের 'জিঘাংসা' ছবিতে অভিনয় করলেন। সেইসঙ্গে 'চয়নিকা চিত্রমন্দির'- ব্যানারে নির্মিত এই ছবির চার প্রযোজকের মধ্যে তাঁর নামটিও পরিচয়লিপিতে ফুটে উঠল। কিছুদিন পর গড়ে তুললেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা, 'বিকাশ রায় প্রোডাকসন'। প্রথম ছবি 'সাজঘর'। পরিচালক- অজয় কর।

প্রযোজনায় যখন এলেন, তখন পরিচালনাই বা বাদ যায় কেন? স্ক্রিপ্ট বা গল্প লেখাতেও তিনি স্বচ্ছন্দ। কাজেই, নিজেই প্রযোজক হয়ে পরিচালনা করলেন প্রথম ছবি, 'অর্ধাঙ্গিনী'। তারপর একে একে উপহার দিলেন, 'সূর্যমুখী', 'বসন্তবাহার', 'মরুতীর্থ হিংলাজ', 'কেরী সাহেবের মুন্সী', 'রাজা সাজা', 'কাজল লতা'-র মতো অসাধারণ সব ছবি।

বাংলা চলচ্চিত্রে বহুমুখী প্রতিভায় এবং স্বকীয়তায় তাঁর অবদান শুধু যে চিরস্মরণীয় তাই নয়; আসলে, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট অধ্যায়। শিল্পী হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য।  মানুষটির মৃত্যু হয়েছিল, আজকের দিনটিতে অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল, ১৯৮৭ সালে।

তথ্যঋণ:সোনার দাগ- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...