পোড়া চামড়ার গল্প

মাসাররাত। মাসাররাত মিশবা। পাকিস্তানের বাসিন্দা। যে দেশের পরিচয় তামাম দুনিয়ার কাছে গোঁড়ামি আর উগ্রমীর খেরোর খাতায় বন্দি! দুনিয়াকে ঠাট্টা করে মাসাররাত সেখানে অন্য জীবনের গদ্য লিখে চলেন রোজ। রোজ।

mm-3

আসুন, পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ি মাসাররাতের স্যালোঁ-য়।  

তাঁর কথায়, “মানুষের জীবনে এমন এক একটা দিন আসে, যে দিনটা পালটে দেয় তার সমস্ত আগামীকে। আমার জীবনেও তেমন একটা দিন এসেছিল। ডিপলিক্স নামে একটা বিউটি স্যালো চালাতাম। অন্য দিনের মতো সেদিনও রেডি হচ্ছি। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরব। হঠাৎ স্যালোর ট্রেনি একটা মেয়ে এসে জানাল, এক মহিলা এসেছেন রিসেপশনে। আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। এ দিকে আমি ব্যাগ গোছাচ্ছি, বেরব। বললাম, কাল আসতে বলো, আজ তো সময় শেষ। কিন্তু মহিলা নাছোড়বান্দা।’’

মিশবার সঙ্গে দেখা না করে তিনি যাবেন না। বাধ্য হয়ে সময় দিলেন মিসবা। তারপর? ‘‘ঘরে ঢুকে দেখি বোরখা ঢাকা এক মহিলা। আমি কিছু বলার আগেই সেই অপরিচিতা আগন্তুক বলে উঠলেন, আমার সাহায্য চাই ওঁর। আজ যদি আমি ফিরিয়ে দিই তাহলে আর কোথাও দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না। মহিলার গলায় কী যে আতঙ্ক, কী যে আকুতি ছিল! মায়া লাগল আমার।’’

তখনও মিশবা জানতেন না পরবর্তী মুহূর্তগুলোয় জন্য কী অপেক্ষা করে আছে! হিজাবের ওড়না সরালেন মহিলা। তখনই প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি। চোখ থেকে গোটা শরীরে, প্রত্যেকটা স্নায়ুতন্ত্রে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল মিশবার।

‘‘তাকাতে পারছিলাম না। পুড়ে যাচ্ছিলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। থপ করে বসে পড়লাম মাটিতে! পায়ে জোর নেই। মাথা টলছে! এতক্ষণ যাকে মহিলাভাবছিলাম, তিনি আসলে সদ্য তরুণী! কিন্তু মুখ দেখে বোঝার উপায় কই।’’

কী দেখলেন মিশবা?

‘‘পুরো মুখটা নেই! নাকের জায়গায় শুধু দুটো গর্ত। চিবুকটা গলার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। মুখের মধ্যে জেগে একটা চোখ ছাড়া আর কোনও অংশ অক্ষত নেই। আমার সম্বিত ফিরতে বছর ১৯-এর মেয়েটি জানাল, ওর স্বামী ওর মুখে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছিল। তাতেই মুখের ৮০ শতাংশ ঝলসে গিয়েছে। কোথাও থেকে সে শুনেছে, আমি যে কোনও ধরনের মানুষকে সুন্দর করে তুলতে পারি। মেকআপ দিয়ে যদি তার মুখ আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে পারি, তাই সে আমার কাছে এসেছে।’’

সব কথা শোনার পর মিশবা কোনও কথা বলতে পারেননি অনেকক্ষণ। চুপ করে ছিলেন। কীই বা উত্তর দেবেন তাকে! তাঁর কাছে যে সব মহিলা, তরুণীরা আসে তাদের সমস্যা ত্বকের ছোটখাটো বিষয় নিয়ে। সে সবের সমাধান তাঁর জানা। আর এই মেয়েটির!! সে সমাধান তো তাঁর জানার বাইরে!

মিশবা বলেন, ‘‘তবু নিজেকে কিছুটা থিতু করে ওকে আশ্বাস দিলাম।’’

তরুণী চলে গেল।

  মাসাররাত বলে যান, ‘‘তার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারছিলাম না তাঁকে। সব কাজের মধ্যে কেমন একটা গ্লানিবোধ। অস্বস্তি। সারাক্ষণ মনে হত সারা পাকিস্তানে এ রকম কত মেয়ে আছে! কেউ তাঁদের খোঁজ রাখে না। কী কঠিন তাদের বেঁচে থাকা! আমার আন্দাজ ছিল না এ রকম ধরনের ঘটনায় আক্রান্ত মেয়েদের সংখ্যাটা ঠিক কত হতে পারে। কিন্তু যদি তাদের কোনও উপকারে লাগাতে পারতাম নিজেকে!’’

খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিলেন মাসাররাত। অ্যাসিড বা যে কোনও দাহ্যে আক্রান্ত মেয়েদের যোগাযোগ করতে বলে। উদ্দেশ্য, তাঁর স্যালোঁতে বিনামূল্যে তাঁদের চিকিৎসা করা। যতটা সম্ভব সারিয়ে তোলা।

মাসাররাত বলেন, ‘‘জানতাম না আরও কত বড় ধাক্কা অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য। প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৪০-৫০ জন করে মহিলা আসতে লাগলেন। পাকিস্তানের নানা প্রান্ত থেকে। নানা বয়সের।

সায়রার জীবন পালটে গেল এখান থেকেই।

mm-2

পাকিস্তান। বিভিন্ন হিউম্যান রাইটস অরগ্যানাইজেশন আর সংবাদ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে প্রতিবছর গড়ে ৪০০ থেকে ৭৫০ মহিলা অ্যাসিড বা অন্য কোনও দাহ্য পদার্থের শিকার হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রমণের নেপথ্যে থাকে পারিবারিক হিংসা, ব্যক্তিগত আক্রোশ। অনেক ঘটনা সে কারণে আড়ালে থেকে যায়। অপ্রকাশিত ঘটনাগুলো সামনে এলে পরিসংখ্যানটা কোথায় পৌঁছবে, ভেবে দেখুন!

নিকাহ্‌, দহেজ তো আছেই, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে পড়াশোনা, বা চাকরি বজায়ের জেদের কারণেও হামলার শিকার হতে হয় বহু মেয়েকে।

১৬ বছর আগের সেই সন্ধের অভিজ্ঞতায় মাসাররাত মিশবা তাঁর ডিপলিক্স স্মাইল এগেন ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া বা অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের চিকিৎসায় সাহায্য করে তাঁর এই সংস্থাটি। পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক আক্রান্তদের মেধার ভিত্তিতে স্কলারশিপও দেওয়া হয়। অনেকে আবার বিউটি ট্রেনিং নিয়ে তাঁর স্যালোঁতেই যোগ দেয়।

এখানেও লড়াই কঠিন। মেয়েদের স্বাবলম্বী হতে প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকেই। কিন্তু তারা সেই বাধা কাটিয়ে ফেললে পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার ও মানসিকতা যায় বদলে। কদিন আগেও যাদের অত্যাচার আর কটুক্তি বিদ্রূপের শিকার হতে হয়েছে, তারাই পরিবারে ডাকাবুকো সদস্যের মর্যাদা পেতে শুরু করে।

মাসাররাত মিশবার মতে, “ঘুরে দাঁড়ানোর চাবিকাঠি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। ঘুরে দাঁড়াতে পারলে আত্মবিশ্বাস, সাহস, সম্মান সব ফিরে পাওয়া যায়।

সায়রা, উরজের মতো অসংখ্য মেয়েকে এভাবেই জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দিয়েছেন মিশবা। সব-হারা মেয়েদের ভালবাসায় ঘেরা তাঁর জীবন।

mm-4

একটাই দেশ, দুটি চিত্র। আজ এই কাহিনি পাকিস্তানের, তো কাল অন্যখানে।

মাসাররাতরা শুধু লড়ে যায়। ওদের কোনও দেশ নেই। ধর্ম নেই। জাত নেই। শুধু ভালবাসা জন্ম নেয় এক তীব্র ঘৃণার বিস্ফোরণ থেকে। সে ভালবাসায় ফুল ফোটে...

লালন কয় জাতের কী রূপ

আমি দেখলাম না দুই নজরে।

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে...

mm-1

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...