ওঁরা সবাই ঝলসে খাক। কারও নাকের কাছে একটা গর্ত শুধু। কারও গোটা মুখটাই নেই। কারও গলার, ঘাড়ের, মাথার চামড়া শুকনো পলিমাটির মতো। এঁরা সবাই কিন্তু তরুণী। ওঁদের সুরেলা জীবনটাকে দাহ্য দিয়ে ছারখার করে দিতে চেয়েছে কেউ না কেউ। কারও পড়শি, কারও প্রেমিক, কারও স্বামী, কারও অন্য কেউ।
মাসাররাত তাদের গায়ে নতুন করে ‘মাটি’ লাগিয়ে সারিয়ে দিচ্ছেন পোড়া ক্ষতের যৌবন!
মাসাররাত। মাসাররাত মিশবা। পাকিস্তানের বাসিন্দা। যে দেশের পরিচয় তামাম দুনিয়ার কাছে গোঁড়ামি আর উগ্রমীর খেরোর খাতায় বন্দি! দুনিয়াকে ঠাট্টা করে মাসাররাত সেখানে অন্য জীবনের গদ্য লিখে চলেন রোজ। রোজ।
আসুন, পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ি মাসাররাতের স্যালোঁ-য়।
সায়রা লিয়াকৎ। ওর কথা দিয়েই নয় শুরু করি। মাসাররাতের স্যালোঁতে হেয়ার ড্রেসারের কাজ করে সায়রা। ক্লায়েন্টরা যতবার স্যালোঁতে আসে, প্রতিবার সায়রাকেই খুঁজে নেয়। সায়রা যখন চুল কাটে, তখন কেউ বুঝতেই পারে না ওর একটা চোখে নেই! কী নিপুণ হাতে যখন চুল বদলে মুখের আদল বদলে বদলে দেয় সায়রা, তখন শুধুই মুগ্ধতা। তার কাজের দুনিয়া ভুলে যায় সামনে যে তাকিয়ে আছে তার মুখের বেশির ভাগটা গলে যাওয়া। শুধু মাত্র একটা চোখ। আর দু’টো হাত। এই দুই সম্বল। তাই দিয়েই সায়রার যত ইন্দ্রজাল! অক্ষত দুই হাত দিয়ে সে যখন ক্লায়েন্টের বেসামাল চুলে রঙের রেখা টানে, তখন তার মুখে কী হাসি! এই হাসি তার মন জুড়োনোর, তার জয়ের।
উরয আকবর। সায়রা সঙ্গেই কাজ করে উরয। ও যখন কারও হাত মেহেন্দিতে রাঙিয়ে তোলে তখন তার মুখেও সেই একই হাসির ঝিলিক। কিন্তু সে-হাসি উরযের ঠোঁট অবধি ছড়ায় কই! তার মুখের ৭০ ভাগই যে ঝলসে গিয়েছে আগুনে। তবু দুঃখ নেই উরজের। বরং সে ঢের বেশি খুশি ক্লায়েন্টের বদলে যাওয়া জমকালো চোখের তারায়।
সায়রা আর উরয দু’জনেই পাকিস্তানী। তারা সেই সমস্ত অসংখ্য মহিলার প্রতিনিধি, যারা এক সময় উন্মাদ হিংসা বা উন্মত্ত ‘ভালবাসা’র শিকার!
ভূ-খণ্ডটা পাকিস্তান হোক বা ভারত, সায়রা, উরয, লক্ষ্মী, আমল, নীতু, গীতাদের কোনও সীমানা হয় না। স্থান-কাল-পাত্র বদলে যায়। গল্পগুলো একই থাকে। অ্যাসিড হোক কিংবা আগুন চামড়া পোড়ার যন্ত্রণাটা বদলায় না। আর্তনাদের কোনও দেশ হয় না।
২১ বছরের সায়রা তাই বলে ওঠে, “আসলে প্রতিটা মানুষ চায় সুন্দর হয়ে উঠতে। কিন্তু আমি মনে করি, মানুষের আসল রূপ তার চামড়ার গায়ে নয়, তার মনের ভিতরে জেগে থাকে।”
বছর ২৮-এর উরয তাই কি বলতে পারে, “মানুষ আমাদের কাছে আসে সুন্দর হতে। তাদের জন্য রূপটা প্রয়োজন। বাকি দুনিয়া তাদের যেভাবে দেখতে চায়, তারা ঠিক সেভাবেই সেজে ওঠে। কিন্তু আমার সে প্রয়োজন নেই।”
সায়রাদের মতো পোড়ো রুটির আরও অনেক মুখ এভাবেই সুন্দরের অন্য সংজ্ঞা খুঁজে পেয়েছে। আয়না থেকে পালিয়ে গিয়ে নয়, আয়নার মুখোমুখি হয়ে। তাদের সেই পথ চিনিয়েছে মাসাররাত মিশবা।
মাসাররাত মিশবা তাঁর দেশের একজন প্রথম সারির কসমেটোলজিস্ট। নিজের পেশায় প্রায় এক নম্বরে। এক দশকের বেশি সময় ধরে সায়রাদের মতো মেয়েদের জন্য কাজ করে চলেছেন তিনি। দগ্ধ মেয়েদের জন্য পূর্ব লাহোরে গড়ে তুলেছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কিন্তু কীভাবে শুরু হল ‘পোড়া’ মুখে হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার এই যুদ্ধ?
বলতে গিয়ে মিশবা ফিরে যান ২০০৩ সালের এক সন্ধেতে…..(ক্ৰমশঃ)