মেয়েটার বয়স বারো বছর, আর দশটা বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়েদের মতনই কেটে যাচ্ছিল তার মেয়েবেলা, কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে একটি সংবাদপত্রের একটা পাতা হাতে করে নিয়ে বাবার কাছে ছুটতে ছুটতে এলো। প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বললো দেখো বাবা, আন্দামানে জারোয়াদের একটা বাচ্চার ছবি দিয়েছে দেখো! আমাকে নিয়ে যাবে গরমের ছুটিতে ওখানে? আরে দূর বোকা মেয়ে তা হয় নাকি? ওখানে সবাইকে যেতে দেয়না জারোয়ারা, ওরা আমাদের মত শহরে থাকা মানুষদের পছন্দ করেনা, তুই ওখানে যাবি কি করে?, তবে হ্যাঁ যদি তুই ওদের নিয়ে গবেষণা করিস তাহলে বড় হলে ওখানে অবশ্যই যেতে পারবি-বলেছিলেন বাবা। ছোট্ট একরত্তি মেয়েটা যে ভবিষ্যতে এক অবাক করা কান্ড ঘটাবে তা তার বাবা ভাবতেও পারেননি ।
সেই মেয়েটাই একদিন ভর্তি হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে, স্নাতকের বিষয় নৃতত্ত্ব। বাড়ির লোক পাড়া প্রতিবেশী সব্বাই জিগ্গেস করলো কি হবে এ নিয়ে পড়াশোনা করে? মেয়ে বলল সবুজদ্বীপে যাব তো, তাই। একে একে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করে পিএইচডি'র চৌকাঠও ডিঙ্গিয়ে ফেলে মেয়েটি। গবেষনার সময় মেয়েটা ঘুরে বেড়ালো আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ-এর আদিবাসী দের আনাচে-কানাচে। আদিবাসীরা তাকে ভালোবেসে ফেললো ঘরের মেয়ের মতন, স্থানিয়দের কাছে নাম হয়ে গেল জঙ্গলী ম্যাডাম।
দিনটা ছিলো ১৯৯১ সালের ৪ জানুয়ারি। প্রশাসনের সাহায্যে একটা ছোট জাহাজ মোট তেরোজন যাত্রীকে নিয়ে রওনা হলো সেন্টিনেলিজ দ্বীপে, উদ্দেশ্য একটাই, আদিবাসীদের সাথে এক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা।প্রথম বারের জন্য় এইরকম কোনো দুঃসাহসিক অভিযানে গেল একটি মেয়ে, ডক্টর মধুমালা চট্টোপাধ্যায়। দ্বীপে পৌঁছনোর পর দলটি হেঁটে চলেছে। তটভূমির কাছে পৌঁছতেই হঠাতই গাছের আড়াল থেকে দলে দলে বেরিয়ে এলো সেন্টিনেলীজরা, তাদের অধিকাংশই দলে পুরুষ, দুহাতে তীরধনুক ও বর্শা আর মহিলাদের কোলে রয়েছে শিশুজাড়োয়া ।
আদিবাসী দের কাছে টানার জন্য় জলে নারকোল ফেলতে লাগলেন গবেষণা দলের সদস্যরা। খানিক নিস্তব্ধতা আর তারপর? কয়েকজন জারোয়া জলে নেমে নারকোল তুলতে থাকলো, হইচই করে উঠলেন গবেষকরা, সবাইকে অবাক করে ডক্টর মধুমালা নামলেন জলে, তার দুহাতে নারকোল নিয়ে মহিলাদের দিকে তাকিয়ে ওঙ্গে ভাষায় বলে উঠলেন, নারিয়েলি জাভা জাভা! নারিয়েলি জাভা জাভা এসো এসো নারকোল নাও। এরইমধ্যে এক জাড়োয়া কখন যে তাকে ধনুক তাক করছে, কেউই খেয়াল করেনি, তির ছুটে যাচ্ছে মধূমালার দিকে হঠাতই এক আদিবাসী মহিলা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলেন মধূমালাকে। দিনের শেষে দেখা গেলো আদিবাসীরা প্রত্যেকে তাদের অস্তির ধনুক পায়ের কাছে নামিয়ে । মধুমালা বুঝতে পারলেন তার অধ্যবসায় সার্থক, আস্তে আস্তে হেঁটে উঠলেন সেন্টিনেল দ্বীপে। জানেন এই মধূমালা কে? সেই বারো বছরের মেয়েটি যে বাবার কাছে আন্দামান নিয়ে যাওয়ার বায়না করেছিল, সেই মেয়েই আজকের ডক্টর মধুমালা, আদিবাসী এই মানুষভের জন্যেই তিনি অবহেলায় ছেড়েছেন পশ্চিমের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক চাকরীর সুযোগ। বর্তমানে তিনিই কেন্দ্রীয় সরকারের Social justice & Backward class welfare মন্ত্রকের সহ অধিকর্তা| আজকের এই স্বার্থপরতার যুগে এই মধুমালাদের খুবই প্রয়োজন নয় কি?