ভবতারিণী মন্দির বলতেই মনে পড়ে দক্ষিণেশ্বরের কথা। তবে দক্ষিণেশ্বর ছাড়াও নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় ভবতারিণী মায়ের মন্দির আছে। হুগলির গুড়াপেও ভবতারিণী মায়ের মন্দির রয়েছে। তবে কলকাতায় আরও একটি ভবতারিণী মন্দির রয়েছে। স্থাপত্য রীতি অনুযায়ী সেটিও নবরত্ন মন্দির।
উনিশ শতকে কলকাতায় যে দু'টি নবরত্ন মন্দির তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ১৮৬৫তে ঈশ্বরচন্দ্র নান প্রতিষ্ঠিত নিস্তারিণী কালীমন্দির। নবরত্ন কালীমন্দিরটির দু'পাশে রয়েছে দু'টি আটচালা শিবমন্দির। অন্য নবরত্ন মন্দিরটি হল শ্যামপুকুর এলাকায় বলরাম ঘোষ স্ট্রিটের ভবতারিণী কালীমন্দির। ১৮৮৮তে এটির প্রতিষ্ঠা করেন দয়াময়ীদেবী। এখানেও দু'পাশে দেখা যায় হরেশ্বর ও হরপ্রসন্ন নামক দু'টি শিব মন্দির। ফড়িয়াপুকুর বাস স্টপেজে বাস থেকে নেমে বলরাম ঘোষ স্ট্রিট বা শ্যামপুকুর থানার দিকে এগোলেই চোখে পড়বে এই মন্দির, কারণ শ্যামপুকুর থানার কাছেই এই মন্দির। সেন্ট্রাল এভিনিউ পেরিয়ে শ্যামবাজার এভি স্কুলের পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকে শ্যামপুকুর থানার কাছে গেলেই দেখা মিলবে ভবতারিণী মন্দিরের। বাইরে থেকে মন্দিরটা স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। কারণ সামনে দু'তিনটে বড় বড় গাছ মন্দিরটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে। আশেপাশে বড় বড় বহুতল ফ্ল্যাট বাড়িও একটা কারণ!
মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। উঁচু ভিতের ওপর নবরত্ন শৈলীতে নির্মিত। আকার আয়তনে বেশ বড়। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে মন্দির। প্রথমে তিন খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ, তারপর অলিন্দ, তারপর গর্ভগৃহ।
গর্ভগৃহে বেদীর ওপর ভবতারিণী মায়ের মূর্তি স্থাপন করা রয়েছে। শায়িত মহাদেবের বুকের ওপর ভবতারিণী মায়ের ডান পা। মায়ের পদতলে শায়িত মহাদেব সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি। মা এখানে এলোকেশী, ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজা, বসন পরহিতা, হাতে গলায় নানা অলংকার শোভিতা। মাথায় রৌপ্য মুকুট। টানা চোখদুটোতে শান্ত স্নিগ্ধ ভাব। সমস্ত মুখমণ্ডলে একটা প্রশ্রয়ের স্মিত হাসির অতিসূক্ষ্ম এক রেখা। একেবারে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মূর্তির মতন। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। যা দেখলে মন ভরসা পায়, অকূলে কূল পায়, অন্ধকারে আলোর দিশা পায়। এই রকম প্রসন্নবদনী মায়ের কাছেই তো সবকিছু নিবেদন করা যায় তেমনই আব্দারও করা যায়। জীবনে কোনো ভুল করলে, ভূল পথে গেলে এই মায়ের কাছে এসে সব খুলে বলা যায়। মায়ের কাছে ক্ষমাও চাওয়া যায়। এই তো মায়ের চিরায়ত মূর্তি। যিনি সন্তানকে প্রশ্রয় দেবেন, বরাভয় দেবেন, আবার শাসনও করবেন।
দক্ষিণেশ্বরের মাতৃমূর্তির নির্মাতা, দাঁইহাটের নবীন ভাস্করই এই মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঘোষ পরিবারের আদি পুরুষেরা। ঘোষ পরিবারের আদি পুরুষ ছিলেন মকরন্দ ঘোষ, ঘোষরা হুগলী জেলার পাঁইতাল গ্রামের আদি বাসিন্দা। তুলসীরাম ঘোষ হলেন এই পরিবারের ২৩ তম পুরুষ। তিনি ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর দেওয়ান, তার কর্মস্থল ছিলো ঢাকা। তিনি যোগবিদ্যায় সিদ্ধিলাভ করে ঢাকা শহরে জয়কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি সেখান থেকে তাঁর ছোট কাকা বলরাম ঘোষকে সাথে নিয়ে এসে শ্যামপুকুর অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন।
এই বলরাম ঘোষ খুব বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। ঘোষ পরিবারের সদস্যদের মতে, এই বলরাম ঘোষের নামেই আজকের বলরাম ঘোষ স্ট্রিট। সেইসময় এই শ্যামপুকুর অঞ্চলেই তাঁর বাসভবন ছিল। বলরাম ঘোষের যে বৈভব, আর্থিক বা সামাজিক প্রতিপত্তি ছিল সেটা বোঝা যায়, তাঁর নামে রাস্তার নামকরণের মাধ্যমে। তবে তাঁর কোনো সন্তানাদি ছিল না। আবার অন্য একটি কিংবদন্তি বলেন, বিখ্যাত বাংলা প্রবাদের হরি ঘোষ, হলেন এই বলরাম ঘোষের পুত্র।
তুলসীরামের দুই পুত্র, শিবপ্রসাদ ও ভবানীপ্রসাদ। এই ভবানীপ্রসাদের পুত্র মাতৃভক্ত হরপ্রসাদ স্বপ্নে এই ভবতারিণী মন্দির প্রতিষ্ঠার আদেশ পেয়ে নিজ বাড়ির সামনে এক বিঘা জমির ওপর মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর অকালমৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিণী দয়াময়ী দেবী ১২৯৪ বঙ্গাব্দে মন্দির নির্মানের কাজ সম্পন্ন করেন। সম্পূর্ণভাবে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আদলে এই মন্দিরটি নির্মান করা হয়। উঁচু ভিতের ওপর ভবতারিণীর মন্দির আর দুই পাশে দুটি আটচালা শিবমন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে কষ্টিপাথরের তৈরি মাঝারি উচ্চতার শিবলিঙ্গ। যার বাঁদিকের নাম হরেশ্বর, ডান দিকের নাম হরপ্রসন্ন। মায়ের মন্দির তৈরি হলেও, মন্দিরে ভবতারিণী মায়ের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রায় এক বছর পর। ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ৫ ই বৈশাখ, বাসন্তী পঞ্চমীর পুণ্য তিথিতে।
মন্দিরের সামনে অসংখ্য থামযুক্ত নাটমন্দির। এক সময়ে মন্দিরের চারপাশে সুন্দর নানারকম ফুলের বাগান ছিল। পিতা হরপ্রসাদ এবং মাতা দয়াময়ী দেবীর মৃত্যুর পরে, সারদাপ্রসাদ পুজার্চনার ভার দক্ষ হাতেই সামলেছেন। সারদাপ্রসাদের কনিষ্ঠ পুত্র ভূপেন্দ্রপ্রসাদ যেমন একদিকে ছিলেন মাতৃভক্ত আবার অন্যদিকে ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। তিনি ভক্তিসহকারে যেমন মায়ের পুজোর দায়িত্ব সামলাতেন, তেমনই তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ভবতারিণী সঙ্গীত সম্মীলনী’র ব্যবস্থাপনায় মায়ের মন্দিরের সামনের নাটমন্দিরে প্রতি সন্ধ্যায় ভক্তিগীতির আসর বসত। সেখানে অনেক নামী শিল্পীকেও আমন্ত্রণ জানানো হত। ভূপেন্দ্রপ্রসাদের সময়ে মায়ের মন্দিরের দুই পাশে শিবমন্দিরে প্রতিবছর শিবরাত্রির দিন যেমন ঘটা করে শিবের পুজো হতো তেমনই নাটমন্দিরে সারারাত্রব্যাপী, যাত্রা নাটক প্রভৃতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত।
এখানে মায়ের নিত্যভোগ হয়। তবে রান্নাকরা ভোগ মাকে নিবেদন করা হয় না। ভিজে আতপ চাল, ফলমূল ও মিষ্টি ইত্যাদির নৈবেদ্য দেওয়া হয়। শিবরাত্রির দিনও শিবকে চাল, কলা ও অন্যান্য ফলমূল এবং মিষ্টি দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। নীল ষষ্ঠীর দিন শিবের বিশেষ পুজো হয়। প্রতি অমাবস্যাতেই মায়ের পুজো হয়। সেদিন যজ্ঞ করা হয়। মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন অর্থাৎ বসন্ত পঞ্চমীর দিন বড় করে মায়ের পুজো হয়।
যেহেতু রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে মন্দিরে তাই দোল উৎসব পালিত হয়। দোলের আগের দিন চাঁচর জ্বালানো হয়। ঢোল, কাসর ঘন্টা বাজিয়ে কীর্তন করতে করতে নারায়ন শীলাকে নিয়ে যাওয়া হয় চাঁচরের কাছে। ওখানে পুজো, হোম এবং প্রদক্ষিণের পর হোমের আগুন দিয়ে চাঁচর জ্বালানো হয়। এই মন্দিরের প্রথম পূজারী ছিলেন বিনয় কৃষ্ণ ঠাকুর। তিনি ছিলেন রাধাকৃষ্ণের ভক্ত। তিনি তাঁর ঘরে নিত্য পুজো করতেন রাধাকৃষ্ণের। তাঁর মৃত্যূর পর তাঁর পূজিত রাধাকৃষ্ণের মূর্তিই মা ভবতারিণীর মূর্তির পাশে বসানো হয়। এখানে কৃষ্ণের মূর্তিটি কষ্টিপাথরের এবং রাধার মূর্তি অষ্টধাতুর তৈরি। জন্মাষ্টমীর দিন রাধাকৃষ্ণের পুজো হয়। সেদিন শাল কাঠ দিয়ে যজ্ঞ করা হয়।
এই মন্দির ইতিহাসে ঐতিহ্যের দলিল। এত উঁচু বিশাল নবরত্ন মন্দির, দুপাশে আটচালা শিবমন্দির সামনে নাটমন্দির; সব কিছু নিয়ে বৈভব, কৌলিন্য আর সৌন্দর্য্যবোধের পরিচয় বহন করে চলেছে মন্দিরটি। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলরাম ঘোষ স্ট্রিটের ভবতারিণী মন্দির।